ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল  মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩২)

সংখ্যা: ১৮৩তম স | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

২. শায়খ-এর নির্দেশিত যিকির-ফিকির

দশটি মাকাম হাছিলের অভিলাষী মুরীদের দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে, স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার নির্দেশ মত যিকির-ফিকির করা।

যিকির-ফিকির-এর ফযীলতঃ

হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট ইমাম, ফক্বীহুল আসর, সুলতানুল আরিফীন, ইমাম হযরত আবূ লাইছ নছর ইবনে মুহম্মদ হানাফী সমরকন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আল্লাহ পাক-এর যিকির-ফিকির করলে বিশেষ পাঁচটি গুণ অর্জিত হবে।

(১) আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উভয়ের সন্তুষ্টি-রেযামন্দি লাভ হবে।

(২) আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উভয়ের ইতায়াত (অনুসরণ-অনুকরণ) করার অধীর আগ্রহ পয়দা হবে।

(৩) শয়তান তাকে ভয় পাবে। শয়তানের ওয়াসওয়াসা হতে সে মুক্ত থাকবে। (৪) ক্বলব (অন্তর) নরম হবে।

(৫) সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে পারবে। (তাম্বীহুল গাফিলীন-২৮৩)

 হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমায়ির রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন “যদি কোন লোক বিছানায় শুয়ে আল্লাহ পাক-এর যিকির করতে করতে ঘুমিয়ে যায়, তাহলে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত তাকে যিকিরকারী বলে গণ্য করা হবে। (সুবহানাল্লাহ)। (তাম্বিহুল গাফিলীন-১৮০)

মূলতঃ সমস্ত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ স্ব স্ব মুরীদণ্ডমু’তাকিদ মুহিব্বীনদেরকে যিকির-ফিকির, রিয়াজত, মাশাক্কাত করার জন্য বিশেষভাবে তাকীদ দিয়েছেন। খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী প্রায় প্রত্যেক দিন, প্রতিটি মজলিশে মুরীদ, মু’তাকিদ, মুহিব্বীনদেরকে বেশী বেশী যিকির-ফিকির করতে বলেন।

তিনি বলেন, “পাছ আনফাছ” যিকির করলে দুনিয়ার মুহব্বত দূর হবে, আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত পয়দা হবে। গোনাহÑখতা মাফ হবে, রিযিকে বরকত হবে, আপদণ্ডবিপদ, বালা-মুছীবত দূর হবে। মৃত্যুর সময় কালিমা শরীফ নছীব হবে। (সুবহানাল্লাহ)।

উল্লেখ্য যে, তাছাউফপন্থীগণ দুনিয়াবী সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ইলমে তাছাউফ শিক্ষার জন্য সময় অতিবাহিত করেন। তারপরেও অধিকাংশ লোক আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ মা’রিফাত ও মুহব্বত হাছিলে ব্যর্থ হয়। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে যিকির-ফিকির থেকে বিমুখ হওয়া। আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত-মা’রিফাত হাছিল করার জন্য যত আমল রয়েছে সালিক বা মুরীদকে সমস্ত আমলই করতে হবে। যত পথ আছে সমস্ত পথেই  তাকে গমনের কোশেশ করতে হবে। অন্যথায় তা হাছিল করা সম্ভব হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ছাত্র পরীক্ষা দেয়ার সময় তাকে অনেক প্রকার প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নপত্র দেয়া হয়। তাকে সবগুলিরই উত্তর দিতে হয়। যদি কোন একটি প্রশ্নের উত্তর না দেয় তাহলে সে পূর্ণ নম্বর পায় না। যতটির উত্তর দেয় তত নম্বরই পায়। ইলমে তাছাউফের বিষয়টি তদ্রুপ। বিষয়টি সহজবোধ্য করার জন্য একটি ওয়াকিয়া (ঘটনা) উল্লেখ করছি।

একদা কোন এক দেশে তিনজন দরবেশ ছিলেন। প্রথম দরবেশ, দ্বিতীয় দরবেশ ও তৃতীয় দরবেশ। তাঁরা ইলমে তাছাউফ (গভীর তত্ত্বজ্ঞানের) সন্ধান করে বেড়াচ্ছিলেন।

প্রথম দরবেশ একস্থানে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন- যতক্ষণ না তাঁর মাথা যন্ত্রণায় টন্ টন্ করে ততক্ষণ তিনি মোরাকাবায় মগ্ন থাকতেন।

দ্বিতীয় দরবেশ একস্থানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মুরাকাবায় (ধ্যানস্থ) থাকতেন। যতক্ষণ না তাঁর পা দেহভার রাখতে অক্ষম হয় ততক্ষণ তিনি মুরাকাবায় (ধ্যানস্থ) থাকতেন।

তৃতীয় দরবেশ দিন-রাত বসে কিতাব পড়তেন। চোখ যতক্ষণ ঝাপসা না হয় ও নাক না ব্যথা করে ততক্ষণ তিনি এক নাগাড়ে পড়ে যেতেন।

কিন্তু এই পদ্ধতিতে তাঁরা কেউ ইলমে তাছাউফের (গভীর তত্ত্ব জ্ঞানের) সন্ধান পেলেন না। অবশেষে তাঁরা তিন জন যুক্তভাবে কর্মপন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত করলেন। তাঁরা পৃথকভাবে সাধনার পথ পরিহার করে যৌথভাবে সাধনার মাধ্যমে ইলমে তাছাউফ (গভীর তত্ত্বজ্ঞান) লাভের পথ অনুসন্ধান করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।

তিন দরবেশ একযোগে মুরাকাবায় (গভীর ধ্যানে) নিমগ্ন হলেন। চল্লিশ দিন তাঁরা মুরাকাবায় (ধ্যানস্থ) থাকার পর হঠাৎ একদিন দেখতে পেলেন, সাদা ধোঁয়ার কু-লীর মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আত্মপ্রকাশ করলেন। আচমকা সেই বক্তির দিকে লক্ষ্য করে দরবেশ তিন জন বিব্রত হলেও আত্মসংবরণ করে বললেন, “আপনি কি সেই খিজির আলাইহিস্ সালাম! আপনি মানুষের পথ প্রদর্শক? দ্বিতীয় দরবেশ মন্তব্য করলেন, না তিনি একজন কুতুব। দুনিয়ার স্তম্ভ তিনি।” তৃতীয় দরবেশ মন্তব্য করলেন, আমি নিশ্চিত যে, ইনি একজন আবদাল। সাধারণ মানুষের উর্ধ্বে একজন মহামানব।”

তিন দরবেশের মন্তব্য শেষ হলে সেই ব্যক্তি গভীর স্বরে বললেন, “না, আমি তিনজনের কেউ না। আপনারা যে জিনিসের সন্ধান করছেন আমি তাই। আমি ইলমে তাছাউফ বা গভীর তত্ত্বজ্ঞানের প্রতীক। যা আপনারা অনুসন্ধান করছেন।”

দরবেশ তিন জন সমস্বরে বললেন, “হ্যাঁ আমরা তাই খুঁজছি।”

সেই ব্যক্তি আবার বললেন, “আপনারা কি প্রবাদবাক্য শোনেননি যে, যত মানুষ তত পথ, যত হৃদয় তত পন্থা। যা হোক আপনাদের জন্য আমি পথ বাতলে দিচ্ছি।

প্রথম দরবেশ মুর্খের মুলুকে সফর করবেন। দ্বিতীয় দরবেশ যাদুর আয়না তালাশ করে বেড়াবেন। তৃতীয় দরবেশ নদীর ঘূর্ণাবর্তের জীনদের সাহায্য লাভের চেষ্টা করবেন।” তিন দরবেশকে তিন রকম নছীহত করে সেই ব্যক্তি গায়িব বা অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রথম দরবেশ চিল্লা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। চলার পথে তিনি পথচারীদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “মুর্খের মুলুক কোন দিকে ভাই?” কেউ দরবেশকে পাগল ভাবলো, কেউবা সসম্মানে জানালো, না বাবা! আমি জানি না। এমনি করে অনেক দিন ধরে নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে প্রথম দরবেশ মুর্খের দেশে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখতে পেলেন রাস্তা দিয়ে এক মহিলা একটা দরজা কাঁধে নিয়ে অতি কষ্টে পথ চলছে। দরবেশ প্রশ্ন করলেন “মা! তুমি দরজা কাঁধে নিয়ে পথ চল কেন?”

মহিলা দরবেশের প্রশ্নের জবাবে জানালো, “আমার স্বামী আজ সকালে কাজে যাওয়ার আগে বলে গেছেন, বউ! ঘরে অনেক মূল্যবান জিনিস রয়েছে। লক্ষ্য রেখো, যেন কেউ দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ না করে।” তাই আমি বাড়ির বাইরে যাচ্ছি বলে দরজাটা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছি। যাতে কেউ দরজা দিয়ে না ঢোকে। সেই জন্যে দরজাটা নিজের হিফাজতে রেখেছি। এবার আপনি পথ ছাড়–ন বাবা! আমাকে যেতে দিন।

দরবেশ বললেন, “দেখ মা! বৃথাই তুমি দরজা কাঁধে নিয়ে ঘুরছ। আসল ব্যাপারটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। ওটাকে বয়ে বেড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই।”

মহিলাটি বললো, “না। আপনাকে বোঝাতে হবে না। বরং আপনি বলুন, দরজার ওজনটা কি করলে কমানো যায়।”

প্রথম দরবেশ হতাশ হয়ে বললেন, না মা! ওজন কমাতে আমার সাধ্য নেই।” অতঃপর উভয়ে ভিন্ন দিকে অগ্রসর হলো।

কিছু দূর চলার পর প্রথম দরবেশ এক দল লোকের সাক্ষাৎ পেলেন। লোকগুলো একটা তরমুজ দেখে ভিড় জমিয়ে ভীত হয়ে সেটা প্রত্যক্ষ করছিল। দরবেশকে দেখে তারা বললো, বাবা! এই ধরনের মারাত্মক জন্তু আমরা আর কখনও দেখিনি। জন্তুটা আরও বড় হয়ে হয়তো আমাদের খেয়েই ফেলবে। আমরা এটাকে স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছি।

দরবেশ বললেন, “তোমরা যদি অনুমতি দাও তা হলে এটা কি জিনিস তা তোমাদের বুঝিয়ে বলতে পারি।”

লোকগুলো সমস্বরে বললো, “দরবেশ সাহেব! বোকার মত কথা বলবেন না। আগে জন্তুটা হত্যা করুন। আপনাকে আমরা পুরস্কার দেব।

তাদের কথা মত দরবেশ একটা ছুরি নিয়ে তরমুজটা কেটে খাওয়া আরম্ভ করলেন।

দরবেশকে তরমুজ খেতে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত লোকগুলো অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে প্রাণ ভয়ে পালাতে লাগলো। তারা বলতে বলতে ছুটলো দোহাই বাবা দৈত্য! আপনি জন্তুকে খেয়েছেন ভাল করেছেন। এবার ফিরে যান। দোহাই আপনার! আমাদের হত্যা করবেন না।

এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রথম দরবেশ বুঝলেন যে, মুর্খের মুলুকে মুর্খদের মত চিন্তা করতে হবে। চালচলনে তাদের মত না হলে বাঁচার কোন উপায় নেই। এইভাবে বহু বৎসর মুর্খের মুলুকে ঘুরতে ঘুরতে দরবেশ বহু কষ্টে গুটি কয়েক লোককে একটু যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। এই কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে তিনি ইলমে তাছাউফ তথা গভীর তত্ত্ব জ্ঞানের অধিকারী হলেন। কিন্তু মুর্খের দেশে সবাই মনে করলো যে, দরবেশ বাবা ক্ষেতের গোলাকার অদ্ভূত জন্তুগুলো কেটে তার রক্ত শোষণ করেই এত জ্ঞানী ও মর্যাদা সম্পন্ন হয়েছেন। তাই তারা সকলেই ক্ষেতের তরমুজ কেটে খেতে শুরু করলো। কিন্তু তাতে তাদের কা-জ্ঞান এবং মর্যাদা কিছুমাত্র বাড়লো না। (অসমাপ্ত)

এদিকে দ্বিতীয় দরবেশ তাঁর নির্দেশিত পথে অগ্রসর হলেন। দেশের পর দেশ ভ্রমণ করতে লাগলেন। অনেক দরবেশ-ফকিরের সাথে সাক্ষাৎ হলো। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)