ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)

সংখ্যা: ১৮২তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(২) শায়খ-এর নির্দেশিত যিকির-ফিকির:-

দশটি মাক্বাম হাছিলের অভিলাষী মুরীদের দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে, স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার নির্দেশ মত যিকির- ফিকির করা।

যিকির-ফিকির-এর ফযীলত:

عن انس بن مالك رضى الله تعالى عنه  قال  قال رسول  الله  صلى  الله  عليه   اذا مررتم  برياض الجنة  فارتعوا  قالوا  وما رياض الجنة قال حلق الذكر.

অর্থঃ হযরত আনাছ ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “যখন তোমরা জান্নাত-এর বাগানে পৌছবে, তার ফল খেয়ে নিও। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! জান্নাতের বাগান কি? তিনি বললেন, যিকিরের মজলিস হচ্ছে জান্নাতের বাগান।”  (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে-

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه  قال قال رسول  الله  صلى عليه  وسلم  لا يقعد قوم  يذكرون  الله  الا حفتهم  الملائكة  وغشيتهم  الرحمة  ونزلت  عليهم  السكينة  وذكرهم  الله  فيمن عنده.

অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব নবীদের নবী রসূলদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যখন কিছু লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহ পাক-এর যিকির করতে বসে তখন ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে নেন, আল্লাহ পাক-এর রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে, তাদের উপর ছাকিনা (শান্তি) বর্ষিত হতে থাকে এবং স্বয়ং আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের সামনে তাদের ছানা-ছিফত করতে থাকেন।” (সুবহানাল্লাহ) (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)

عن ابى درداء رضى الله تعالى عنه قال قال النبى صلى الله عليه وسلم الا انبئكم بخير اعمالكم وازكاها عند مليككم وارفعها فى درجاتكم وخير لكم من انفاق الذهب والورق وخير لكم من ان تلقوا عدوكم فتضربوا اعناقهم ويضربوا اعناقكم قالو بلى قال ذكر الله.

অর্থঃ হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দিব না যে, “কোন আমল সর্বোত্তম? তোমাদের মালিক আল্লাহ পাক-এর নিকট অধিক পবিত্রতা লাভের কারণ এবং মর্যাদা-মর্তবা বৃদ্ধির ব্যাপারে অধিক কার্যকর? সর্বোপরি তোমাদের পক্ষে সোনা-রূপা দান করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং শত্রুর মোকাবিলা করা বা জিহাদ করা তথা শত্রুরা তোমাদের গর্দান কাটবে আর তোমরাও তাদের গর্দান কাটবে- তা হতেও উত্তম? তাঁরা বললেন, জি হ্যাঁ। বলুন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তখন তিনি বললেন, “সে আমল হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর যিকির।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাযাহ শরীফ, মিশকাত শরীফ)

হাদীছে কুদসীতে বর্ণিত আছে-

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الله تعالى انا عند ظن عبدى بى وانا معه اذا ذكرنى فان ذكرنى فى نفسه ذكرته فى نفسى وان ذكرنى فى ملا ذكرته فى ملا خير منهم.

অর্থঃ হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক বলেন, “বান্দা আমাকে যেরূপ ধারণা করে আমি তার নিকট সেরূপই। যখন সে আমার যিকির করে তখন আমি তার সাথী হই। যখন সে মনে মনে আমার যিকির করে তখন আমিও মনে মনে তাকে স্মরণ করতে থাকি। আর যখন সে কোন মজলিসে আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি।“ সুবহানাল্লাহ। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)

একদা একজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা যদি জানতে পারতাম কোন্ সম্পদ উত্তম তবে তা সঞ্চয় করতাম।

তখন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমাদের শ্রেষ্ট সম্পদ হলো আল্লাহ পাক-এর যিকিরকারী জিহ্বা, শোকর গোযার অন্তর এবং ঈমানদার স্ত্রী, যে তার ঈমানের (দ্বীনের) ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত শরীফ)

হযরত আনাছ ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

ذكرالله عليم الايمان وبراءة من النفاق وخصن  من  الشيطان وحرز من النار.

অর্থঃ “আল্লাহ পাক-এর যিকির ঈমানের ইল্ম অর্থাৎ ঈমান ও আক্বীদার হাক্বীক্বতে পৌছার ইলম দানকারী। নিফাকী (কপটতা) থেকে মুক্ত রাখে, শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকার সুরক্ষিত দুর্গ এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে।” (তাম্বীহুল গাফিলীন-২৭৯)

আরো বলা হয়েছে যে, যিকিরের উদাহরণ হচ্ছে সেই সম্প্রদায়ের মত, যাদের সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী দুর্গ রয়েছে। আর তাদের শত্রু ও রয়েছে। যখন সেই শত্রু তাদেরকে আক্রমণ করতে আসে, তারা তখন সেই দুর্গে প্রবেশ করে তার দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। ফলে সেই শত্রুর আক্রমণ হতে নিরাপত্তা লাভ করে।”

মূলতঃ শয়তানের ওয়াসওয়াসা, নফসের ধোকা, গাইরুল্লাহ-এর ধোকা এবং সকল গুনাহ হতে মুক্তি লাভের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর যিকির। হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট একদা এক ব্যক্তি আসলেন। তাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, হুযূর! আমাকে কিছু নসীহত করুন।

হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তাকে বললেন তুমি পাঁচটি বিষয় স্মরণ রাখবে (১) তোমার উপর যা কিছু আপতিত হবে মনে করবে সবই আল্লাহ্ পাক-এর ফয়সালায় (আদেশে) হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন মাখলুকাতকে কখনো কোন ব্যাপারে অভিযুক্ত করবে না। (২) তোমার জিহ্বা কে সংরক্ষণ করবে যেন সমস্ত মাখলুকাত তোমার জিহ্বা থেকে নিরাপদ থাকে। তাহলে তুমি আল্লাহ পাক-এর আযাব-গযব (অসন্তুষ্টি) থেকে মুক্ত থাকবে।

(৩) আল্লাহ পাক তোমাকে রিযিক দানের ব্যাপারে যে ওয়াদা করেছেন তাকে সত্য বলে প্রতিপাদন করবে। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক তোমাকে যে রিযিক দান করবেন  তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। সে ব্যাপারে কোন অভিযোগ করবে না।

(৪) সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকবে যেন, গাফিল অবস্থায় তোমার মৃত্যু না হয়।

(৫) যেখানে থাক না কেন অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাক-এর যিকির করবে। তাহলে সমস্ত গুনাহখতা, ফিৎনা-ফাসাদ ইত্যাদি হতে নিরাপদ থাকতে পারবে। (তাম্বীহুল গাফিলীন-২৮১)

উল্লেখ্য যে, অপ্রয়োজনীয় কথা-বার্তা বললে, অধিক হাসলে দিল মুর্দা হয়ে যায়। যার জন্য আওলিয়া কিরামগণ স্বীয় মুরীদ, মু’তাকিদগণকে তা থেকে বিরত থাকার জন্য জোর তাকিদ দিতেন। আর সব সময় যিকির-ফিকিরে মগ্ন থাকার নির্দেশ দিতেন।

হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি দুনিয়াবী কথা-বার্তা বলছেন। তিনি তার নিকট কিছুক্ষণ দাড়ালেন। অতঃপর বললেন, আচ্ছা তুমি কি এসব কথা-বার্তা বলাতে কোন ছাওয়াবের আশা কর?

সে ব্যক্তি বললো, না। তিনি পুনরায় বললেন, তুমি কি তাহলে বিশ্বাস কর যে, এ কারণে তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে?

সে ব্যক্তি বললো, না। আমি তা মনে করি না। তাহলে তুমি এসব কথা কেন বল, যে কথায় কোন ছওয়াবও হবে না আবার গুনাহও হবে না। হে ব্যক্তি! তুমি আল্লাহ পাক-এর যিকিরকে লাযিম (আবশ্যক) করে নাও।

অর্থাৎ সব সময় যিকির-ফিকির করতে থাক তাহলে অনর্থক কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা হতে নিরাপদ থাকতে পারবে। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল  মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩২)