ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

সংখ্যা: ১৮১তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(২) শায়েখ-এর নির্দেশিত যিকির-ফিকির

দশটি মাকাম হাছিলের অভিলাষী মুরীদের দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে, স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার নির্দেশ মত যিকির-ফিকির করা।

শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার নির্দেশিত আমল যিকির-ফিকিরে শয়তান কোন প্রকার প্রভাব ফেলতে পারে না। ফলে শয়তানের ওয়াসওয়াসা হতে মুক্ত থাকা অতীব সহজ ও সম্ভব হয়। অন্যথায় শয়তান সেখানেও নেক ছূরতে ধোঁকা দেয়ার সুযোগ পায়। মনে রাখবে, যে আমল বা যিকির-ফিকির শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার অনুমোদিত নয়, সে আমল বা যিকির-ফিকিরে শয়তানের ওয়াস্ওয়াসামুক্ত থাকা সম্ভব নয়। মুলতঃ শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা যেভাবে যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দেগী করতে বলবেন মুরীদ সেভাবে যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দেগী করলে অতি অল্প সময়ে মঞ্জিলে মাকসুদে পৌছতে পারবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একদিন মরুচারী এক ব্যক্তি, আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট হাজির হয়ে বললেন-

دلنى على عمل اذا عملته دخلت الجنة قال تعبدالله ولاتشرك به شيئا وتقيم الصلوة الـمكتوبة وتؤدى الزكوة الـمفروضة وتصوم رمضان قال والذى نفس بيده لا ازيد على هذا شيئا ولا انقص منه.

অর্থঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন, যে আমল করলে আমি (আপনার সন্তুষ্টিনিহীত) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো।” তখন আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি আল্লাহ পাক-এর ইবাদত করবে। উনার সাথে কাউকে শরীক করবে না। ফরয নামায আদায় করবে। নির্ধারিত যাকাত দিবে। আর রমাদ্বান শরীফে রোযা রাখবে।” সে ব্যক্তি একথা শুনে বললেন, ঐ সত্ত্বার কসম! যার কুদরতী হাত মুবারকে আমার জীবন রয়েছে। আমি এগুলো থেকে বিন্দুমাত্র বেশিও করবো না এবং কমও করবো না। অতঃপর লোকটি চলে গেলেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আমলের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখে খুবই খুশি হলেন এবং বললেন-

من سره  ان ينظر الى رجل من اهل الجنة فلينظر الى هذا

অর্থঃ “যে ব্যক্তি জান্নাতী লোক দেখে আনন্দিত হতে চায় সে যেন এ ব্যক্তির দিকে তাকায়। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)

একইভাবে যদি কোন মুরীদ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার নির্দেশমত যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দেগী করে সেও অতি সহজেই আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত, সন্তুষ্টি, রেজামন্দী হাছিল করতে সক্ষম হবে।

যিকির-ফিকিরের ফযীলতঃ

عن ابى سعيد رضى الله تعالى عنه  ان رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل اى العباد افضل وارفع درجة عند الله يوم القيمة قال الذاكرون الله كثيرا والذاكرات قيل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ومن الغازى فى سبيل الله قال لو ضرب بسيفه فى الكفار والـمشركين حتى ينكسر ويخـتضب دما فان الذاكر لله افضل منه درجة.

অর্থঃ হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা কর  হল, “কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক-এর নিকট বান্দাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন হবেন?” তিনি বললেন, আল্লাহ পাক-এর যিকিরকারী পুরুষ ও যিকিরকারী নারী। আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, “ইয়া রসূূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় জিহাদকারী অপেক্ষাও কি?” তিনি বললেন হ্যাঁ; যদি তার তরবারি ভেঙ্গে যায়। আর সে নিজে রক্তাক্ত হয় তা হতেও আল্লাহ পাক-এর যিকিরকারী শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান। (আহমদ, তিরমিযী, মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে,

عن ابى موسى رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مثل الذى يذكر ربه والذى لا يذكر مثل الحى والميت .

অর্থঃ হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে আপন রবের যিকির করে এবং যে যিকির করে না, তাদের উদাহরণ যথাক্রমে জীবিত ও মৃতের ন্যায়। (বুখারী, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)

অর্থাৎ যারা যিকির করে তাদের ক্বলবে সবসময় যিকির জারী থাকে। কাজেই তারা জীবিত। আর যারা আল্লাহ পাক-এর যিকির করে না তাদের ক্বলবে যিকির জারী নেই। ফলে তারাই মৃত। তাদের ক্বলব মুর্দা।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। আল্লাহ পাক-এর জনৈক ওলী যার ক্বলবে (অন্তরে) আল্লাহ পাক-এর যিকির জারী ছিল। তিনি ছহিবে কাশ্ফও ছিলেন। তিনি একদিন কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন কিছু লোকের সমাগম। তিনি তাদের নিকটবর্তী হলেন। দেখতে পেলেন নিকটবর্তী একটি কবরস্থানে এক ব্যক্তিকে দাফন করতঃ তালক্বীন দিচ্ছেন।

উল্লেখ্য যে, মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করার পর তালক্বীন দেয়া সুন্নত। তাতে মৃত ব্যক্তির সুওয়ালের জাওয়াব দিতে সহজ হয়। অনেকক্ষেত্রে তাকে সুওয়ালও করা হয় না। কবরে উপস্থিত দু’জন ফেরেশ্তা পরস্পর একথা বলতে বলতে চলে যায় যে, তাকে আর কি সুওয়াল (প্রশ্ন) করবো, তাকে তো সবকিছু শিখিয়ে দেয়া হলো। তাদের সেই তালক্বীন দেয়া দেখে উক্ত বুযূর্গ ব্যক্তি হাসলেন।

উপস্থিত লোকজন সেই কঠিন সময়ে কবরস্থানে তাঁকে হাসতে দেখে বললেন, “হুযূর! বেয়াদবী মাফ করবেন। আপনি তো বুযূর্গ ব্যক্তি। আমরা জানি কবরস্থানে হাসা নিষেধ। কবরস্থানে দুনিয়াবী কথা বললে চল্লিশ বছরের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়।

আর যদি তার সেই বয়স না হয় তাহলে সেই পরিমাণ গুনাহ হয়। অর্থাৎ চল্লিশ বৎসরের গুনাহ তার আমলনামায় লিখা হয়।

অথচ আপনি হাসছেন। তার কারণ কি?“ তখন সেই বুযূর্গ ব্যক্তি বললেন, মূলতঃ দাফনকৃত সেই ব্যক্তির কথা শুনে আমার হাসি আসছে। দাফনকৃত ব্যক্তি আমাকে ডেকে বলছেন, দেখুন, মৃত ব্যক্তি যিন্দা ব্যক্তিকে তালকীন দেয়।

সেই বুর্যুগ ব্যক্তি আরো বললেন, দাফনকৃত ব্যক্তি ছিলেন যিকিরকারী। যার ক্বলব জারী ছিলো। আর যে ব্যক্তি তাকে কবরে রেখে তালক্বীন দিচ্ছেন সে যিকিরকারী নয়। তার ক্বলবে যিকির জারী নেই। কাজেই সে ব্যক্তিই মূলত মৃত। আর দাফনকৃত ব্যক্তির যিকির জারী থাকার কারণে তিনি মূলতঃ জিন্দাই রয়েছেন। মৃত ব্যক্তির তালক্বীন জিন্দা ব্যক্তির জন্য কতটুকু ফায়দা দায়ক হবে?

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে,

عن عبد الله بن بسر ان رجلا قال يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ان شرائع الاسلام قد كثرت على فاخبرنى بشئ اتثبت به قال لا يزال لسانك رطبا من ذكر الله.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুসর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। একদা এক ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শরীয়তের বিষয়গুলো আমার কাছে অত্যাধিক কঠিন মনে হচ্ছে। কাজেই, আমাকে এমন একটি উপায় অবহিত করুন, যাতে আমি ইস্তিক্বামত (অবিচল) থাকতে পারি।

আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার জিহ্বাকে সবসময় আল্লাহ পাক-এর যিকির দ্বারা সজীব রাখবে।” (আবু দাউদ শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, মুসতাদরিকে হাকীম)

অর্থাৎ দায়িমী যিকির করলে হক্ব মত ও পথে ইস্তিক্বামত থাকা সহজ ও সম্ভব হবে। আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন আদেশ নিষেধই কঠিন কষ্টকর মনে হবে না। বরং অতি সহজ ও শান্তিদায়ক হয়ে যাবে।

(অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল  মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩২)