ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

সংখ্যা: ১৮০তম সংখ্যা | বিভাগ:

 হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

 

 

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

শায়খ-এর নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার

এই দশটি মাক্বাম হাছিলের জন্য সালিক বা মুরীদের সর্বপ্রথম করনীয় হচ্ছে শায়খ বা মুর্শিদ-এর নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার করা। গত সংখ্যায় ছোহবত ইখতিয়ারের যে তারতীব বর্ণনা করা হয়েছে সে মুতাবিক ছোহবত ইখতিয়ার করাকে নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার বুঝানো হয়েছে। মূলতঃ পূর্ববর্তী সমস্ত ইমাম মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম স্বীয় মুরীদ-মু’তাকিদ, মুহিব্বীনদেরকে ছোহবত ইখতিয়ারের বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন। খাজীনায়ে সুন্নাহ, মাখজানুল মা’রিফাহ, ইমামুল মুত্তাক্বীন, সুলতানুল আরিফীন হযরত আবু বকর ছায়দালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “তোমরা আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত ইখতিয়ার কর। যদি তা করতে না পার তাহলে এমন লোকের ছোহবত ইখতিয়ার কর যিনি সবসময় আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত ইখতিয়ার করেন। কেননা এরূপ ব্যক্তির ছোহবত তোমাদেরকে আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌছে দিবে। আর সেই ছোহবতের বরকতে তুমি উভয় জগতে মর্যাদা সম্পন্ন হবে।” সুবহানাল্লাহ (তাযকিরাতুল আওলিয়া-৩/১৯৮)।

কামরুল আওলিয়া, সুলতানুয যাহিদীন, কুতুবুয্ যামান, ইমামুস্ ছিদ্দীক্বীন, হযরত আবুল আব্বাস ইবনে আহমদ কাচ্ছার রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “মুরীদের পক্ষ্যে সামান্য সময় শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবতে থাকা একশত রাকায়াত নফল নামায আদায় করা হতে উত্তম। আর খাওয়ার সময় এক লোকমা কম খাওয়া সারা রাত নফল নামায আদায় করা হতে ভাল।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া-৩/১৭১)

সুলতানুল আরিফীন, জারুল্লাহ, ইমামুল হুদা শাহ ছূফী হযরত আবু উসমান সাঈদ ইবনে সালাম মাগরিবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “যে ব্যক্তি ওলী আল্লাহগণের ছোহবত পরিত্যাগ করে ধনী লোকদের ছোহবত ইখতিয়ার করে আল্লাহ পাক তার দিলকে মৃত ও অন্ধ করে দেন।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া-৩/২২৬)

ছোহবত ইখতিয়ারের আদবঃ

সালিক বা মুরীদকে ছোহবতের আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী। কারণ আদব ব্যতীত এ পথে সফলতা লাভ করা যায় না। ‘আদবে আওলিয়া বেয়াদবে দেউলিয়া’ কথাটি সবসময় স্মরণীয়। পূর্ববর্তী সমস্ত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ স্বীয় মুরীদকে ছোহবত ইখতিয়ার করার আদব শিক্ষা দিয়েছেন। সুলতানুল মাশায়িখ, ফকীহুল আছর হযরত খাজা মামশাদ দিনুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত ইখতিয়ারের পূর্বে নিজকে শূন্য করে নিবে। কারণ যে ব্যক্তি শায়খ-এর ছোহবতে গিয়ে নিজের মধ্যে কিছু মান-মর্যাদা এবং আমিত্ববোধের গন্ধও বাকী রাখবে সে ব্যক্তি শায়খ-এর উপদেশের ফায়দা এবং ছোহবতের বরকত হতে বঞ্চিত থাকবে।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া-৩/১৯২)

সুলতানুয যাহিদীন, ফখরুল আওলিয়ায়িল কামিলীন, হযরত আলী হাজবিরী দাতা গঞ্জে বখ্শ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “ছোহবত ইখতিয়ারের আদব এবং শর্ত হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তির পদ মর্যাদা অনুযায়ী তার সাথে ব্যবহার করবে। বয়স্কদেরকে পিতার ন্যায় মনে করে তাকে শ্রদ্ধা করবে। সম বয়স্কদেরকে ভাইয়ের মত মনে করে তাদের সাথে সৎ ও শিষ্টতাপূর্ণ আচরণ করবে। ছোটদেরকে পুত্রের ন্যায় মনে করে তাদেরকে স্নেহ ও আদর করবে। সর্বোপরি ছোহবত ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করবে। হিংসা বিদ্বেষ, পরনিন্দা, শত্রুতা এবং পরের অনিষ্টতা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে। প্রত্যেকের মঙ্গল কামনা করবে। কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দিবে না। জেনে রাখবে পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং খিয়ানত মানুষের অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে থাকে।” (কাশফুল মাহজুব-১৯২)

তিনি আরো বলেন, আমি হযরত শায়খ আবুল কাশিম গুরগানী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ছোহবত ইখতিয়ার করার শর্ত কি?

তিনি বললেন, “মানুষকে আনন্দ দিবে এবং উপকার করবে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ছোহবত ইখতিয়ার করার মধ্যে যাবতীয় বিপদ নিহীত। ছোহবত ইখতিয়ার করার মাধ্যমে কামিয়াবী ঐ সময় হাছিল হবে যখন তুমি সর্বক্ষেত্রে অন্যের স্বার্থ ও শান্তিকে অগ্রাধিকার দিবে।”   (কাশফুল মাহজুব-১৯৩)

সুলতানুল মাশায়িখ, ফকীহুল আছর, হযরত খাজা মামশাদ দিনুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “মুরীদের জন্য ছোহবতের আদব হচ্ছে- স্বীয় শায়খ-এর যথাযথ তা’যীম-তাকরীম করবে। নিজেদের সালিক বা মুরীদ ভাইদের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। শরীয়তের নিয়ম-কানুন এবং উহার অনুসরণ করাকে আদর্শরূপে সামনে রাখবে। নফসের কামনা-বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকবে।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া-৩/১৯২)

খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেছেন, “কোন মাখলুকাতকে কষ্ট দিয়ে কখনো বড় ওলী আল্লাহ হওয়া যায় না।” কাজেই, কোন মাখলুকাতকে কষ্ট দিবে না।

(২) শায়খ-এর নির্দেশিত যিকির-ফিকিরঃ

দশটি মাকাম হাছিলের অভিলাষি মুরীদের  দ্বিতীয় করনীয় হচ্ছে স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ-এর নির্দেশ মত যিকির-ফিকির করা।

যিকির হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। আল্লাহ পাক বলেন,

ولذكرالله اكبر

অর্থঃ “আর আল্লাহ পাক-এর যিকিরই শ্রেষ্ঠতম ইবাদত।” (সূরা আনকাবুত-৪৫)

আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন,

واذكرا الله  ذكثيرا  لعلكم تفلحون

অর্থঃ “তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাক-এর যিকির কর। অবশ্যই তোমরা সফলতা লাভ করবে। (সূরা জুমুয়া-১০)

আল্লাহ পাক আরো বলেন,

ياايها الذين امنوا اذكروا الله ذكرا كثيرا. وسبحوه بكرة واصيلا.

অর্থ:- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাক-এর যিকির কর। বিশেষত: সকাল ও সন্ধায় তাঁর তাছবীহ (যিকির) পাঠ কর। (সূরা আহযাব-৪১/৪২)

উক্ত আয়াত শরীফ-এর তাফসীরে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اكثروا  ذكر الله  حتى يقولوا  مجنون.

অর্থঃ “তোমরা এতো অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাক-এর যিকির করবে, লোকেরা যেন তোমাদেরকে পাগল বলে।”

আফযালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী  হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “মুরীদ ফরয-ওয়াজিব এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদা আদায়ের পর সবসময় আল্লাহ পাক-এর যিকিরে অতিবাহিত করবে।“ (মাকতুবাত শরীফ)

যিকির-এর দ্বারা বদ খাছলত দূর হয়ঃ

যিকির-ফিকির-এর দ্বারা অন্তরের যাবতীয় বদ খাছলত দূর হয়। আর বদ খাছলত দূর হলে নেক খাছলত দ্বারা অন্তর পরিপূর্ণ হয়।

আল্লাহ পাক-এর হাবীব আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لكل شىء صقالة وصقالة القلوب ذكر الله وما من شىء انجى من عذاب الله من ذكر الله قالو ولا الجهاد فى سبيل الله قال ولا ان يضرب بسيفه حتى ينقطع.

অর্থঃ “প্রত্যেক জিনিষ পরিষ্কারে একটা যন্ত্র রয়েছে, আর অন্তর পরিষ্কার করার যন্ত্র হল আল্লহ পাক-এর যিকির। আল্লাহ পাক-এর যিকির অপেক্ষা আল্লাহ পাক-এর আযাব হতে অধিক নাযাতদানকারী আর কোন জিনিষই নেই। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় জিহাদ করাও কি নয়? তিনি বললেন, আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় তরবারি মারলেও নয় এমন কি এটা যদি ভেঙ্গেও যায়। (বায়হাকী শরীফ)

দায়িমী যিকির কারীকে শয়তান ধোঁকা দিতে পারে না।

হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الشيطان جاثم على قلب ابن ادم فاذا ذكر الله خنس واذا غفل وسوس.

অর্থঃ হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শয়তান আদম সন্তানের দিলের উপর বসে থাকে যখন সে আল্লা‎হ পাক-এর যিকির করে সে ভেগে যায় আর যখন সে যিকির থেকে গাফিল হয় তখন ওয়াস্ওয়াসা দিতে থাকে। (বুখারী শরীফ) (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল  মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩২)