সম্পাদকীয়

সংখ্যা: ১৮০তম সংখ্যা | বিভাগ:

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মালিক রব তায়ালার জন্য সব ছানা-সিফত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্যই সকল দুরূদ ও সালাম। যাঁর উছীলায় মহান আল্লাহ পাক আখিরী উম্মতকে নছীব করেছেন রমদ্বানুল মুবারক।

যোগ্যতা ও মর্যাদা সাপেক্ষে রোযাদারদের রোযা তিন প্রকারে মূল্যায়িত হয়ে থাকে। পানাহার, কাম ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা সাধারণ লোকের রোযা বলে গণ্য হয়। এই বিরতির সাথে সাথে সর্বাঙ্গকে যাবতীয় ছগীরা-কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা মধ্যম স্তর ওলীআল্লাহগণের রোযা বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এরও পরে যাবতীয় গায়রুল্লাহ থেকে ফারাক হয়ে দিলকে সর্বোতরূপেই বারী তায়ালার দিকে রুজু করাই হচ্ছে, আখাস্সুল খাছ ওলীআল্লাহ, ছিদ্দীক এবং আম্বিয়া আলাইহিস্ সালামগণের রোযার শান। অর্থাৎ ইলমে তাছাউফ শিক্ষার মাধ্যমে খাছ ওলীআল্লাহ হওয়ার দ্বারাই হাক্বীক্বী রোযার স্বাদ লাভ সম্ভব।

উল্লেখ করা যেতে পারে, পৃথিবীতে প্রথম ইবাদতসমূহের মাঝে রোযা অন্যতম। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যে রোযা রাখতেন তা ‘আইয়্যামে বীজ’ নামে পরিচিত। এরপর আহলে কিতাবগণ ছাড়াও রোযার দর্শন ও প্রয়োগ প্রতিফলিত হয় অন্যান্য ধর্মেও। প্রাচীন গ্রীক, পারস্য, মিসর, ভারতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রীক বর্ষপঞ্জির থিসমোফোরিয়া মাসের তৃতীয় দিনের উপবাস, পারসিকদের পাঁচসালা উপবাস ব্রত এবং হিন্দুদের একাদশীর ব্রত এক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ।

প্রায়শ্চিত্য সিয়াম এবং জাতীয় দুর্যোগ শোকের ক্ষেত্রসহ ‘আব’ মাসের প্রথম নয় দিন এবং তামুসের সতের তারিখে আংশিক সিয়ামের বিবরণ জিউস এনসাইক্লোপিডিয়াতে পাওয়া যায়। অপরদিকে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম সিয়াম পালন করলেও তাঁর সিয়াম পালনের যে ধারাবাহিকতা পাদ্রী সম্প্রদায় অব্যাহত রাখেনি।

প্রাদী পল, এরিনিয়াসহ নানা পাদ্রীর নানা মত প্রবর্তনের পর চার্চ তাদের সিয়ামের দিন নির্ধারণ করে এবং এখানেই শেষ নয় ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম জেমস ও এলিজাবেথের সময় পার্লামেন্টেও সিয়ামের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করে। পার্লামেন্ট এই মর্মে ঘোষণা দেয় যে, ‘সিয়ামের দিন গোশ্ত খাওয়া যাবে না।’ পার্লামেন্ট যুক্তি হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের সহায়ক বলে উল্লেখ করে।

স্মর্তব্য, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টকে বলা হয় গণতন্ত্রের জননী। আর আসমানী কিতাব হারিয়ে এবং কুরআন শরীফ অস্বীকারের পর ডেমোক্রেটিক পার্লামেন্ট গঠন এবং সকল বিষয়সহ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পার্লামেন্টের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া খ্রিস্টানদের সীমাহীন গুমরাহীই প্রমাণ করে।

উল্লেখ্য, রোযার সাথে যাকাতের একটা অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, যাকাতও পবিত্রতা ঘটায়। তবে এ পবিত্রতা মালের বা অর্থের। আর অর্থের মূল মালিক হচ্ছে আল্লাহ পাক। কাজেই আল্লাহ পাক-এর নির্দেশিত পথে অর্থ আয়-ব্যয়েই- ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সফলতা ও সমৃদ্ধি। সে সফলতার দ্বার বন্ধ রেখে ভিন্ন পথে ঘুরে যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তার জন্য কেবল আফসুসই করা যায়।

প্রসঙ্গতঃ বিবেচ্য, অপেক্ষাকৃত অনেক বড় স্বার্থ বিকিয়ে দেবার পাঁয়তারার অভিযোগের পরিবর্তে সামান্য গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তি ও তার ব্যর্থতায় আমাদের যে পরিহাস, সে পরিহাস কি সত্যিই কবুল করার মত? অথচ হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, ‘যাকাত অনাদায়ের কারণে অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি হয়।” মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এই হাদীছ শরীফ-এর প্রতি অবমাননা করাই কী হবে আমাদের সঠিক পরিচয়? ইসলামী আইন শাস্ত্র বিশারদদের মতানুযায়ী যাবতীয় অবৈধ কর রহিতকরণের বিপরীতে বলিষ্ঠভাবে যাকাত আদায়ের কোন সদিচ্ছাই কী আমাদের জাগবে না? জাগবেনা কী তার সুফল দর্শনের এতটুকু বাসনা? আর সে কী বহুদূর? এক হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে আমানত রয়েছে তা থেকে যথাযথ যাকাত আদায় হলে দশ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় সম্ভব।

স্মর্তব্য যে, কিছুকাল পূর্বে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিলো, কেবলমাত্র এক হাজার কোটি টাকায় সুষ্ঠু প্রয়োগের দ্বারাই বাংলাদেশের দারিদ্র্য মোচন সম্ভব। কিন্তু তারপরেও যারা সে পথ পরিহার করে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “উত্তম জিনিসের পরিবর্তে নিকৃষ্ট জিনিসই কী তোমাদের পছন্দ।” (সূরা বাক্বারা-৬১)

বলার অপেক্ষা রাখেনা, যাকাতবিহীন, পুঁজিবাদী, সুদী ও দুর্নীতি নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে দরিদ্রদের আরো দরিদ্র এবং বিত্তশালীদের আরো বিত্তবান করছে।

গভীর পরিতাপের বিষয়, আজকে মুসলমানগণ নামাযকে যতটা গুরুত্ব দেয়, যতটা আগ্রহভরে তারা মসজিদের পর মসজিদ করে, রোযা তাদের জীবনে  যতটা প্রভাব বিস্তার করে সে তুলনায় যাকাতের বিষয়টি তাদের মানসিকতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।

জেদ্দাস্থ আইডিবি সূত্র মতে, বিশ্বের অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে মাত্র ৬টি মুসলিম দেশে যাকাত  আদায়ের নামমাত্র ব্যবস্থা রয়েছে।

মূলতঃ যাকাত অনাদায়ে এতসব ব্যর্থতার মূলে আমাদের নামধারী আলিমদের নির্লিপ্ততাই অনেকাংশে দায়ী। কারণ যাকাতের গুরুত্ব, তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ, এর প্রয়োগিক দিক বিশ্লেষণ ও সচেতনতা সৃষ্টি এবং এ সম্পর্কিত গবেষণা ও সমন্বয় সাধনের মত মৌলিক কাজের পরিবর্তে তারা আজ  আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে লংমার্চে, হরতালে, গণতন্ত্রে, ব্লাসফেমী, মৌলবাদ দাবিতে, কুশপুত্তলিকা দাহ ইত্যাদি হারাম কর্মসূচীতে। মূলতঃ ইসলামী আদর্শে দৃঢ় থেকে ইসলামী সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ নয় বরং বিজাতীয় কর্মসূচীতেই অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামী অনুশাসনের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনই হয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্য। বাজারে ত্রুটিপূর্ণ সময়সূচী সম্বলিত রমযানের ক্যালেন্ডার প্রকাশ তাদের সে চরম অবহেলারই একটি প্রমাণ। মূলতঃ নিজ ধর্মীয় আদর্শ থেকে দূরে অবস্থানকারী, এসব গাফিল উলামায়ে ‘ছূ’রা রোযার মূল আদর্শ থেকে বঞ্চিত।

বলাবাহুল্য, সবাই এবারের রোযায় পরিবর্তিত আবহাওয়ার আমেজ অনুভব করছেন। এর কারণ হলো, রোযার সাথে চাঁদের সম্পর্ক। কিন্তু পূর্বে প্রায় সকল ধর্মেই রোযার সাথে সৌর মাসের সম্পর্ক ছিলো। যে কারণে আমাদের ন্যায় পালাবদলের পরিক্রমায় রোযা রাখার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ তাদের ছিলো না। কিন্তু চাঁদের মাস হিসেবে আখিরী উম্মতগণ বিভিন্ন ঋতুতে রোযা রাখার নিয়ামত লাভে লাভবান হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, রোযা-ঈদ চাঁদ দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত, উদয়ের সাথে নয়। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু কর এবং চাঁদ দেখে তা শেষ করো।” (তিরমিযী শরীফ)

বলার অপেক্ষা রাখেনা, এই চাঁদ দেখে রোযা শেষ করার দিন অর্থাৎ আনন্দ ও খুশির দিন, ‘ঈদুল ফিতর’ ক্রমশঃই ঘনিয়ে আসছে। তবে এ আনন্দ প্রকৃত অর্থে লাভ করতে পারেন রোযাদারগণ, মুত্তাক্বীগণ। বে-রোযাদার হয়ে, বেশরা, বেপর্দা ও বেহায়াভাবে যারা ঈদ পালন করে তারা আসলে ঈদের আনন্দ লাভ করতে পারে না বরং শয়তানী আনন্দেই তাদের নফস তৃপ্ত হয়। সে তৃপ্তি কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়।

মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে ঈদের হাক্বীক্বী খুশী নছীব করুন। (আমীন)

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়