সুওয়াল জাওয়াব

সংখ্যা: ২৯৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ আরীফুল হক

নূরানীবাদ।

সুওয়াল: পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ কি? এ সম্পর্কে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: ‘আখিরি’ শব্দটির অর্থ- শেষ। আর ‘চাহার শোম্বাহ’ শব্দ এর অর্থ- আরবিআ বা বুধবার। ‘পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ’ বলতে ছফর মাসের শেষ আরবিয়া বা বুধবারকে বুঝানো হয়ে থাকে। মূলত এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য মহা খুশির দিন।

এ মুবারক দিনটি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, পবিত্র ১১ হিজরী সনের পবিত্র মুহররমুল হারাম শরীফ উনার তৃতীয় সপ্তাহে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি পবিত্র জান্নাতুল বাক্বী মুবারক যিয়ারত করার বিষয়ে পবিত্র ওহী মুবারক করেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র জান্নাতুল বাক্বী মুবারক যিয়ারত মুবারক করেন এবং পবিত্র যিয়ারত মুবারক শেষে উনার নূরুল হুদা মুবারক অর্থাৎ ছের মুবারকে মারীদ্বী বা অসুস্থতা শান মুবারক গ্রহণ করেন। এর ৮/১০ দিন পর তিনি আবার সুস্থতা বা ছিহ্হাতী শান মুবারক প্রকাশ করেন। অতঃপর পবিত্র ছফর শরীফ মাস উনার তৃতীয় সপ্তাহে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি পবিত্র জান্নাতুল বাক্বী মুবারক যিয়ারত মুবারক করার বিষয়ে পবিত্র ওহী মুবারক করেন। অতঃপর তিনি পবিত্র জান্নাতুল বাক্বী যিয়ারত মুবারক করেন। পবিত্র যিয়ারত মুবারক শেষে তিনি পবিত্র হুজরা শরীফে তাশরীফ মুবারক রাখেন এবং তিনি ‘ওয়াহ রা’সাহু’ ‘ওয়াহ রা’সাহু’ অর্থাৎ আমার নূরুল হুদা মুবারক অর্থাৎ ছের মুবারক, নূরুল হুদা মুবারক অর্থাৎ ছের মুবারক একথা বলে উনার নূরুল হুদা মুবারক অর্থাৎ ছের মুবারক উনার মারীদ্বী শান মুবারক উনার কথা উল্লেখ করেন এবং পর্যায়ক্রমে মারীদ্বী শান মুবারক বৃদ্ধি পেতে থাকে। অতঃপর এই পবিত্র ছফর শরীফ মাস উনার ৩০ তারিখ ইয়াওমুল আরবিয়া বা বুধবার দিন সকালে তিনি ছিহ্হাতী শান মুবারক গ্রহণ করেন। ফলে ভোরবেলা ঘুম মুবারক থেকে জেগে তিনি বললেন, ‘আমার নিকট কে আছেন?’ এ কথা শুনামাত্রই সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বাহ আলাইহাস সালাম তিনি ছুটে আসলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আমি হাযির আছি।’ তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘হে হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বাহ আলাইহাস সালাম! মারীদ্বী শান মুবারক ত্যাগ করে ছিহহাতী শান মুবারক গ্রহণ করার ফলে শরীর মুবারক বেশ হালকা মনে হচ্ছে।’ সুবহানাল্লাহ! এ কথা শুনে হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বাহ আলাইহাস সালাম তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি পানি এনে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূরুল হুদা মুবারক অর্থাৎ ছের মুবারক ধুয়ে দিলেন এবং সমস্ত নূরে মুজাসসাম অর্থাৎ জিসিম মুবারক উনার মধ্যে পানি মুবারক ঢেলে ভালোভাবে গোসল মুবারক করিয়ে দিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে কাপড় মুবারক ভিজিয়ে নূরে মুজাসসাম অর্থাৎ জিসিম মুবারক মুছে দিলেন। সুবহানাল্লাহ! এ সংবাদ পেয়ে অন্যান্য হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা খিদমত মুবারকে হাযির হলেন।

অতঃপর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘হে হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বাহ আলাইহাস সালাম! হুজরা শরীফে কোনো খাবার আছে কি?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘জী-হ্যা।’ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘আমার জন্য তা নিয়ে আসুন আর আমার আওলাদ অর্থাৎ সাইয়্যিদাতুনা হযরত আন নূরুর রবিয়াহ যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকেসহ অন্যান্য আওলাদ আলাইহিমুস সালাম ও আলাইহিন্নাস সালাম উনাদেরকে খবর দিন। আর সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলে বাইতি রসূলিল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছালিছ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকেও নিয়ে আসতে বলুন। সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বাহ আলাইহাস সালাম তিনি সকলকে সংবাদ দিলেন। অতঃপর সাইয়্যিদাতুনা হযরত আন নূরুর রবিয়াহ যাহরা আলাইহাস সালাম তিনিসহ অন্যান্য আওলাদ আলাইহিমুস সালাম ও আলাইহিন্নাস সালাম উনারা এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছালিছ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা সবাই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারকে এসে হাযির হলেন।

অতঃপর রুটি-গোশত ও সিরকা মুবারক এনে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারকে পরিবেশন করা হলো। তিনি সকলকে নিয়ে খাদ্য মুবারক গ্রহণ করে খুশি মুবারক প্রকাশ করলেন। সংবাদ শুনে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও বাইরে এসে হাযির হন। কিছুক্ষণ পর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বাইরে এসে উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম! আমার পবিত্র বিছাল শরীফ উনার পর আপনাদের অবস্থা কিরূপ হবে?’ এ কথা শুনে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা ব্যাকুলচিত্তে কান্না শুরু করলেন। উনাদের এ অবস্থা দেখে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদেরকে সান্ত্বনা মুবারক দান করলেন। অতঃপর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মসজিদে নববী শরীফ উনার মধ্যে ওয়াক্তিয়া নামায আদায় করলেন। সুবহানাল্লাহ!

মহাসম্মানিত রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দীর্ঘদিন মারীদ্বী শান মুবারক গ্রহণ করার পর ছিহ্হাতী শান মুবারক প্রকাশ করে মসজিদে নববী শরীফ তাশরীফ মুবারক আনেন এবং নামাযের ইমামতি করেন এই অপার আনন্দে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্স্নাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র খিদমত মুবারকে হাদিয়া পেশ করেন। সুবহানাল্লাহ!

বর্ণিত রয়েছে যে, খুশি মুবারক প্রকাশ করে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি সাত হাজার দীনার, হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি পাঁচ হাজার দীনার, হযরত যুন নূরাইন আলাইহিস সালাম তিনি দশ হাজার দীনার, হযরত ইমামুল আউওয়াল কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি তিন হাজার দীনার, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি একশত উট ও একশত ঘোড়া মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় হাদিয়া করতঃ মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত ও সন্তুষ্টি মুবারক লাভ করেন। সুবহানাল্লাহ! আর এ কারণেই পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ পালন করা হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন আলাইহিমুস সালাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের খাছ সুন্নত মুবারক উনার অন্তভুর্ক্ত। সুবহানাল্লাহ! উনাদেরকে অনুসরণ করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন –

وَالَّذِيْنَ اتَّـبَـعُوْهُمْ بِاحْسَانٍ رَّضِىَ الله عَنْـهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ

অর্থ: “যারা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং উনারাও মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল করতে পেরেছেন।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা তওবা শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ১০০)

আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْـخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْـمَهْدِيِّيْنَ

অর্থ: “তোমাদের জন্য আমার সুন্নত মুবারক এবং আমার হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুন্নত মুবারক পালন করা অপরিহার্য কর্তব্য।” (মিশকাত শরীফ)

মূলকথা হলো- পবিত্র ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ’ অর্থাৎ পবিত্র ছফর শরীফ মাস উনার শেষ ইয়াওমুল আরবিয়া শরীফ বা বুধবার। যা কায়িনাতবাসী সকলের জন্য খুশি মুবারক প্রকাশের দিন। এ উপলক্ষে সকলের জন্য করণীয় র্কতব্য হচ্ছে- উক্ত মুবারক দিনে খুশি প্রকাশ করে সাধ্যমতো হাদিয়া পেশ করা, গোসল করা, ভালো খাওয়া, বেশি বেশি পবিত্র মীলাদ শরীফ, পবিত্র ক্বিয়াম শরীফ পাঠ করা ও পবিত্র দুরূদ শরীফ পাঠ করা। এর সাথে সাথে দান-ছদক্বা করা। আর বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম ও অমুসলিম সরকারের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- এ মুবারক দিনটি পালনের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণসহ এ মুবারক দিন উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা।

কেউ কেউ ‘পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ’ উদযাপন করাকে নাজায়িয ও বিদয়াত বলে আখ্যায়িত করে থাকে। নাঊযুবিল্লাহ! যা সম্মানিত শরীয়ত উনার বিরোধী ও কুফরী। বরং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণে ‘পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ’ উপলক্ষে সাধ্যমত গরিব-মিসকীনদেরকে দান-খয়রাত করা, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি বেশি বেশি ছলাত-সালাম মুবারক, পবিত্র মীলাদ শরীফ, ক্বিয়াম শরীফ ও পবিত্র দুরূদ শরীফ পাঠ করা অত্যন্ত ফযীলত ও কল্যাণ হাছিলের কারণ। {দলীল: সমূহ সীরাতগ্রন্থ।}

মুহম্মদ আসাদুর রহমান

কুড়িগ্রাম

সুওয়াল: সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ফাযায়িল-ফযীলত ও সংক্ষিপ্ত সাওয়ানেহ উমরী মুবারক জানতে বাসনা রাখি।

জাওয়াব: খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে কায়িনাতবাসীর প্রতি নিয়ামতে উজমা বা সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত মুবারক হচ্ছেন মহাসম্মানিত রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এবং উনার মহাসম্মনিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইইহিমুস সালাম উনারা। আর উনাদের মধ্যে বিশেষ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ, সাইয়্যিদুশ শুহাদা, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি।

উনার পরিচয় মুবারক: উনার নাম মুবারক হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম। উনার সম্মানিত পিতা হচ্ছেন: সাইয়্যিদুল আরব, বাবুল ইলিম, আসাদুল্লাহিল গালিব, আশারায়ে মুবাশ্শারার অন্যতম ব্যক্তিত্ব, খুলাফায়ে রাশিদীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের চতুর্থ খলীফা, ইমামুল আউওয়াল মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাইয়্যিদুনা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম। উনার সম্মানিতা মাতা হচ্ছেন: বিনতু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, শাবীহাতু রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাইয়্যিদাতু নিসায়িল আলামীন, সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ, খইরুল বানাত, হযরত আন নূরুর রবিআহ ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম। উনার সম্মানিত নানা হচ্ছেন: সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন নাবিয়্যীন, রহমাতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। উনার সম্মানিতা নানী হচ্ছেন: সাইয়্যিদাতু নিসায়িল আলামীন, সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ, আল মুতহ্হারাহ, আল মুতহহিরাহ, মালিকাতুদ দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ, মালিকাতুল জান্নাহ, সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আল ঊলা খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম। সুবহানাল্লাহ!

বংশ হিসেবে তিনি কুরাইশ। গোত্র হিসেবে হাশিমী। তিনি বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ করেন ৩য় হিজরী সনের ১৫ই রমাদ্বান শরীফ, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার), বাদ-আছর পবিত্র মদীনা শরীফে।

উনার নাম মুবারক রেখেছেন, তা’যীন, তাহনীক মুবারক করেছেন এবং ৭ম দিনে দুটি দুম্বা মুবারক কুরবানী করে আকীকা মুবারক দিয়েছেন স্বয়ং যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন নাবিয়্যীন, রহমাতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ!

তিনি যমীনে অবস্থান মুবারক করেছেন ৪৫ বছর, ৫ মাস, সাড়ে ১২দিন। তিনি ৪৯ হিজরী সনে, ২৮শে ছফর শরীফ, লাইলাতুল জুমুআহ, তাহাজ্জুদের নামাযের সময় শাহাদাতী শান মুবারক প্রকাশ করেন। উনার পবিত্র রওযা শরীফ পবিত্র মদীনা শরীফ জান্নাতুল বাক্বী উনার মধ্যে অবস্থিত।

হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের শত্রু শুরু থেকেই। আগে ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম উনাকে শহীদ করার জন্য শত্রুরা একে একে ৫ বার বিষ পান করিয়েছিল। প্রতিবার তিনি সরাসরি পবিত্র রওযা শরীফ গিয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আরজু মুবারক করার সাথে সাথে বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে তিনি ছিহ্হাতী শান মুবারক গ্রহণ করেন।

কিন্তু ৬ষ্ঠবার যে বিষ পান করানো হয় তা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক বিষ অথার্ৎ হিরকচূর্ণ। হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম উনার আদত বা অভ্যাস মুবারক ছিল যে, তিনি প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের সময় পানি মুবারক পান করতেন। তিনি যে কলসী মুবারক থেকে পানি পান করতেন সে কলসী মুবারকের মুখ একটি কাপড় বেধে রাখতেন যেন কেউ কিছু ফেলতে বা বিষ মিশ্রিত করতে না পারে। কিন্তু শত্রুরা হিরকচূর্ণ বিষ কলসীর মুখে বেঁধে রাখা কাপড়ে মিশিয়ে দিলো। হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম তিনি প্রতিদিনের ন্যায় পানি পান করার জন্য কলসী মুবারক থেকে পাত্রে পানি ঢাললেন- তখন হিরকচূর্ণ বিষসহ পানি পাত্রে পড়লো। তিনি তা পান করার সাথে সাথে মারাত্মক বিষক্রিয়া শুরু হলো এবং তিনি মারাত্মক মারীদী শান প্রকাশ করলেন। এবার আর উনার পক্ষে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ যাওয়া সম্ভব হলো না। তিনি বুঝতে পারলেন যে, উনার বিছালী শান মুবারক প্রকাশের সময় নিকটবর্তী। তাই তিনি উনার ছোট ভাই হযরত ইমামুছ ছালিছ আলাইহিস সালাম উনাকে ডাকলেন এবং বললেন, আমি আজকে তাহাজ্জুদের সময় উঠার আগে একটা স্বপ্ন দেখেছি, আমাদের সম্মানিত নানাজী নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি, আমাদের সম্মানিত পিতা এবং আমাদের সম্মানিতা মাতা উনারা উপস্থিত হয়ে আমাকে বলতেছেন, আপনি অতিসত্বর আমাদের কাছে চলে আসবেন, কোন চিন্তা করবেন না। এটা বলে উনারা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

তিনি ছোট ভাইকে আরো বললেন, হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে খিলাফত দেয়ার সময় যে শর্ত দিয়েছিলাম, আপনার পর আমি অথবা আমার ছোট ভাই আমাদের কাছে খিলাফত ফিরিয়ে দিতে হবে। এ শর্তটি আমি বাদ করে দিলাম। আপনি দ্বীনি তা’লীম তরবিয়ত দানে মশগুল থাকবেন।  হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার পর যাকে ভাল মনে করেন তাকে খিলাফত দিবেন। এব নছীহত মুবারক করার পর তিনি শাহাদাতী শান মুবারক গ্রহণ করেন। অতঃপর গোছল, কাফন ও জানাযা শেষে উনাকে জান্নাতুল বাক্বী শরীফে দাফন মুবারক করা হয়। অথার্ৎ পবিত্র রওজা শরীফ হচ্ছেন জান্নাতু বাক্বী শরীফে।

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র বংশধারা সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ হযরত আন নূরুর রবিয়াহ যাহরা আলাইহাস সালাম ও উনার মহাসম্মানিত আওলাদদ্বয় সাইয়্যিদা শাবাবি আহলিল জান্নাহ, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছালিছ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মাধ্যমে বিশ্বময় জারি রয়েছে।

একবার সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হুজরা শরীফ উনার বাইরে আসলেন, অতঃপর পর্যায়ক্রমে ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইমামুছ ছালিছ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আন নূরুর রবিয়াহ যাহরা আলাইহাস সালাম ও হযরত ইমামুল আউওয়াল কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনারা এসে উপস্থিত হলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদের সকলকে এক চাদরতলে নিয়ে বলেন, “আয় মহান আল্লাহ পাক! উনারা আমার আহলে বাইত শরীফ। উনাদের থেকে আপনি অপবিত্রতা দূর করুন এবং উনাদেরকে পরিপূর্ণ রূপে পবিত্র রাখুন।’ এরপর এ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়-

إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَـيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْـرًا

অর্থ: “হে আহলে বাইত শরীফ! মহান আল্লাহ পাক তিনি অবশ্যই চান আপনাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং আপনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” অর্থাৎ আপনাদের থেকে সমস্ত অপবিত্রতা দূর করে পবিত্র করার মত পবিত্র করেই সৃষ্টি করেছেন। (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ : সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৩ )

নাজরানের ঈসায়ীদের (খৃস্টানদের) একটি প্রতিনিধি দল পবিত্র মদীনা শরীফ-এ আগমন করে। তাদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে। তাদের এলোমেলো বক্তব্যের কারণে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দোয়ার মাধ্যমে এর ফয়ছালা করতে বলেন। এটাকে “দাওয়াতে মুবাহালা” বলা হয়। নূরে মুজাসমাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আহলে বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের কয়েকজন সদস্য উনাদেরকে নিয়ে বাইরে তাশরীফ আনেন। এসব নূরানী চেহারা মুবারক দেখে ঈসায়ীদের প্রধান পাদ্রী তার দলের লোকদেরকে বলে: “আমি এমন সব পবিত্র চেহারা মুবারক দেখছি, উনাদের দোয়া পাহাড় সমূহকেও আপন স্থান হতে হটিয়ে দিতে পারে। সুতরাং উনাদের সাথে মুবাহালা করে ধ্বংস হয়ো না।” হযরত আহলে বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সদস্য হিসেবে হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ইমামুছ ছালিছ মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

 হযরত আবু বাকরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদের সাথে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আসলেন; তখন তিনি ছোট্ট শিশু। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সিজদায় ছিলেন। হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত নূরুল আত্বহার (পৃষ্ঠ মুবারক) মুবারকে অথবা কাঁধ মুবারকে উঠে বসলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে নিয়েই অতি স্নেহপরায়ণভাবে দণ্ডায়মান হলেন। তিনি যখন নামায শেষ করলেন, ছাহাবীগণ উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন: ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি এই শিশু উনার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করলেন তা আপনি আর কারো সঙ্গে করেননি। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ ابْنِىْ هٰذَا سَيِّدٌ وَلَعَلَّ اللهَ اَنْ يُّصْلِحَ بِهٖ بَـيْنَ فِئَـتَـيْنِ عَظِيْمَتَـيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ

অর্থ: নিশ্চয়ই আমার এ সন্তান তিনি হচ্ছেন সাইয়্যিদ। অচিরেই মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার দ্বারা মুসলমানদের দু’টি বৃহৎ দলের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করবেন।  (বুখারী শরীফ)

হযরত ইমাম নাঈম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাকে হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেছেন, যখনই আমি হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতাম আমার চোখে পানি আসত। এটা এ কারণে যে, একদিন আমি দেখতে পেলাম, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দ্রুতবেগে এসে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূরুল আযহার (কোল মুবারক) মুবারকে বসে গেলেন। অতঃপর তিনি দুই নূরুল মাগফিরাত (হাত মুবারক) মুবারকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত নূরুন নিয়ামত (দাড়ি মুবারক) মুবারক ধারণ করলেন, আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত নুরুস সালাম (মুখ) মুবারক হযরত ইমামুছ ছানী মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথার্ৎ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র মুখ মুবারকের নিকটবর্তী করলেন। এমতাবস্থায় তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন: ‘আয় মহান আল্লাহ পাক! নিশ্চয়ই আমি উনাকে মুহব্বত করি, সুতরাং আপনিও উনাকে মুহব্বত করুন।’ এ পবিত্র বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন। সুবহানাল্লাহ!

যখন সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি পবিত্র শাহাদতী শান মুবারক প্রকাশ করলেন, হিজরী ৪০ সনের পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে তখন সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম তিনি খিলাফত মুবারক গ্রহণ করেন। ৪০ হাজার লোক উনার পবিত্র হাত মুবারকে বাইয়াত হন। তিনি খিলাফত ৬ মাস পর্যন্ত পরিচালনা করেন। মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমার পরে খিলাফত মুবারক ৩০ বছর। তন্মধ্যে ২৯ বছর ৬ মাস পূর্ববর্তী খলীফাগণ উনাদের সময়ে অতিবাহিত হয়। বাকি ৬ মাস সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম তিনি পূর্ণ করেন। সুবহানাল্লাহ!

মুহম্মদ আবুল হায়াত

কক্সবাজার, চট্টগ্রাম।

সুওয়াল: কেউ কেউ  বলে থাকে, পীর ছাহেবের কাছে বাইয়াত হওয়ার কি দরকার? উনার দরবার শরীফে যাওয়ার কি দরকার? পবিত্র কুরআন হাদীছেই তো সব জ্ঞান আছে। আর মাদরাসায় পড়লেই তো হয়, বাড়তি পড়ার দরকার কি? তাছাড়া উনার খিদমত, উনার আদেশ নির্দেশ অনুসারে চলার বিষয়টা বাড়াবাড়ি। আল্লাহ পাক ছাড়া কারো অনুগত হওয়া আমার পছন্দ না। এ সকল বিষয়ে সঠিক জাওয়াব দিয়ে বিভ্রান্তি দূর করবেন।

জাওয়াব: পীর ছাহেব ক্বিবলা তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ও মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্বায়িম-মাক্বাম বা স্থলাভিষিক্ত খলীফা বা প্রতিনিধি।

পীর ছাহেব উনার নিকট বাইয়াত হওয়া ফরজ। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, ইলম দুই প্রকার-

عَنْ حَضْرَتِ الْحَسَنٍ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ قَالَ اَلْعِلْمُ عِلْمَانِ فَعِلْمٌ فِى الْقَلْبِ فَذَاكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ وَعِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَذَالِكَ حُجَّةُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلٰى اِبْنِ اٰدَمَ

অর্থ: “হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, ইলিম দু’প্রকার। একটি হচ্ছে ক্বলবী ইলিম (ইলমে তাছাওউফ) যা উপকারী ইলিম। অপরটি হচ্ছে যবানী ইলিম (ইলমে ফিক্বাহ) যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি  দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, মিশকাত, মিরকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ)

অর্থাৎ উভয় প্রকার ইলিম শিক্ষা করা ফরজ। তাই ইলমে ফিক্বাহ মাদ্রাসায় পড়ে বা কোন ওস্তাদ বা শিক্ষকের কাছে পড়ে হাছিল করতে হয়। আর ইলমে তাছাওউফ শিক্ষা করতে হয় যে শিক্ষক বা ওস্তাদের কাছে, তিনিই হচ্ছেন শায়েখ বা মুর্শিদ বা পীর ছাহেব। ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষার জন্য যেমন মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হয়। তদ্রুপ ইলমে তাছাওউফ শিক্ষার জন্য পীর ছাহেব উনার নিকট বাইয়াত হতে হয়। ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষার জন্য যেমন মাদ্রাসায় যেতে হয় তদ্রুপ ইলমে তাছাওউফ শিক্ষার জন্য পীর ছাহেব উনার কাছে যেতে হয়।

উল্লেখ্য পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফে সব থাকার পরও মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হয়। তাই যদি হয় তাহলে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফে থাকার পরেও কেন পীর ছাহেব উনার কাছে যেতে হবে না? আর পীর ছাহেব উনার কাছে যাওয়ার জন্য স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি ও মহাসম্মানিত হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অর্থাৎ উনারাই আদেশ মুবারক করেছেন।

এ প্রসঙ্গে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

يَاَيُّـهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّـقُوا اللهَ وَكُوْنُـوْا مَعَ الصّٰدِقِيْنَ

অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করো এবং ছাদিক্বীন বা সত্যবাদীগণ উনাদের সঙ্গী হও।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৯)

উপরোক্ত আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ছাদিক্বীন দ্বারা পীর ছাহেব উনাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, যাঁরা যাহির-বাতিন, ভিতর-বাহির, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত, ক্বওল-ফে’ল সর্বাবস্থায় সত্যের উপর ক্বায়িম রয়েছেন। অর্থাৎ যাঁরা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাওউফ উভয় ইলমে তাকমীলে (পূর্ণতায়) পৌছেছেন

অর্থাৎ, যিনি বা যাঁরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার মত মুবারক অনুযায়ী মত হয়েছেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথ মুবারক অনুযায়ী পথ হয়েছেন। উনারাই হচ্ছেন পীর ছাহেব।

খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

مَنْ يَّـهْدِ اللهُ فَـهُوَ الْـمُهْتَدِ وَمنْ يُّضْلِلْ فَـلَنْ تَـجِدَ لَهٗ وَلِيًّا مُّرْشِدًا

অর্থ: যে ব্যক্তি হিদায়েত চায় মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে হিদায়েত দান করেন। আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে, সে কোনো ওলীয়ে মুর্শিদ (কামিল শায়েখ) লাভ করতে পারে না।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা কাহফ্ শরীফ : সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ১৭)

অর্থাৎ যারা কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হয়না অর্থাৎ উনার সোহবত এখতিয়ার করেনা, উনার নিকট যাতায়াত করেনা, তারা পথভ্রষ্ট। কারণ তাদের পথ প্রদর্শক হয় শয়তান। নাঊযুুবিল্লাহ!

যার কারণে সুলত্বানুল আরিফীন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সাইয়্যিদুত ত্বায়িফা হযরত জুনায়িদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারাসহ আরো অনেকেই বলেছেন যে-

مَنْ لَّيْسَ لَهٗ شَيْخٌ فَشَيْخُهٗ شَيْطَانٌ

অর্থ : “যার কোনো শায়েখ বা মুর্শিদ নেই, তার মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক হলো শয়তান।” নাঊযুবিল্লাহ! (ক্বওলুল জামীল, নুরুন আলা নূর, তাছাওউফ তত্ত্ব)

আর শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلشَّيْخُ فِىْ اَهْلِهٖ كَالنَّبِىِّ فِىْ اُمَّتِهٖ وَفِىْ رِوَايَةٍ اَلشَّيْخُ لِقَوْمِهٖ كَالنَّبِىِّ فِىْ اُمَّتِهٖ

অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা উম্মতের নিকট যেরূপ সম্মানিত ও অনুসরণীয়, শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা তিনিও উনার অধীনস্থদের নিকট তদ্রƒপ সম্মানিত ও অনুসরণীয়।” (দায়লামী শরীফ, মাকতুবাত শরীফ, জামিউল জাওয়ামি’, আল মাক্বাছিদুল হাসানাহ, তানযীহুশ শরীয়াহ, আল মীযান, আল জামিউছ ছগীর, আদ দুরারুল মুনতাশিরাহ ইত্যাদি)

অর্থাৎ হযরত নবী-রসূল আলাইহিস সালাম উনার দ্বারা যেরূপ উম্মতের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়, সেরূপ পীর ছাহেব বা শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার দ্বারা মুরীদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়। সুবহানাল্লাহ!

অতএব, হযরত নবী-রসূল আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত না হয়ে যেরূপ ইছলাহ ও নাজাত লাভ করা যায় না, তদ্রƒপ কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত ইছলাহ বা পরিশুদ্ধতা ও নাজাত লাভ করা যায়না। বরং শয়তানী প্রবঞ্চনায় পড়ে গোমরাহীতে নিপতিত হওয়াই স্বাভাবিক।

আর এ কারণেই জগদ্বিখ্যাত আলিম, আলিমকুল শিরোমণি, শ্রেষ্ঠতম মাযহাব, হানাফী মাযহাব উনার প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম, ইমামুল আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

لَوْلَا سَنَـتَانِ لَـهَلَكَ اَبُـوْ نُـعْمَانَ

অর্থ : “(আমার জীবনে) যদি দু’টি বৎসর না পেতাম, তবে আবূ নু’মান (আবূ হানীফা) ধ্বংস হয়ে যেতাম।” (সাইফুল মুকাল্লিদীন, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া)

অর্থাৎ আমি যদি আমার শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনাদের নিকট বাইয়াত না হতাম, তবে আমি ধ্বংস বা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম।

সুতরাং প্রমাণিত হলো, যে ব্যক্তি কোনো কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত না হবে, তার পক্ষে শয়তানী প্রবঞ্চনা ও বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত ক্বলবে যিকির জারি করা অসম্ভব। আর ক্বলবে যিকির জারি করা ব্যতীত শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

وَمَنْ يَّـعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمٰنِ نُـقَيِّضْ لَهٗ شَيْطَانًا فَـهُوَ لَهٗ قَرِينٌ. وَإِنَّـهُمْ لَيَصُدُّوْنَـهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ وَيَحْسَبُـوْنَ أَنَّـهُمْ مُّهْتَدُوْنَ

অর্থ : “যে ব্যক্তি খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র যিকির থেকে বিরত (গাফিল) থাকে, আমি (খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক) তার জন্য একটি শয়তান নিযুক্ত করে দেই। অর্থাৎ তার গাফলতীর কারণেই তার সাথে একটা শয়তান নিযুক্ত হয়ে যায়। অতঃপর সেই শয়তান তার সঙ্গী হয় এবং তাকে সৎ পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত করে দেয়। অথচ তারা মনে করে, তারা সৎ পথেই রয়েছে।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা যুখরূফ শরীফ : সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৬, ৩৭)

তাই পরিশুদ্ধতা লাভ করার জন্য বা ক্বলবে যিকির জারি করার জন্য অবশ্যই একজন কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হতে হবে।

আর এ কারণেই পৃথিবীতে যত হযরত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা আগমন করেছেন, উনাদের প্রত্যেকেই কোনো একজন শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হয়েছেন এবং উনারা উনাদের স্ব স্ব কিতাবে শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাকে ফরয বলেছেন। যেমন- গউছুল আ’যম, মাহবূবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, ইমামুল আইম্মাহ হযরত বড়পীর আব্দুল ক্বাদির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব ‘সিররুল আসরার’ নামক কিতাবে লিখেন-

وَلِذَالِكَ طَلَبُ اَهْلِ الْتَـلْقِيْنِ لِـحَيَاةِ الْقُلُوْبِ فَـرْضٌ

অর্থ : “ক্বল্ব্ জিন্দা করার জন্য অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য ‘আহলে তালক্বীন’ তালাশ করা অর্থাৎ কামিল মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয।” অনুরূপ ‘ফতহুর রব্বানী’ কিতাবেও উল্লেখ আছে।

তদ্রƒপ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ব সমাদৃত কিতাব ‘ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত’ কিতাবে, ক্বাইউমুয যামান হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘মাকতুবাত শরীফ’ কিতাবে, আওলাদে রসূল, আশিকে রসূল হযরত আহমদ কবীর রেফায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার আল ‘বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ’ কিতাবে উল্লেখ করেন যে, “অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য বা ইলমে তাছাওউফ অর্জন করার জন্য একজন কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হওয়া ফরয।”

অনুরূপ তাফসীরে রূহুল বয়ান, তাফসীরে রূহুল মায়ানী ও তাফসীরে কবীর ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে।

মূলত কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা তিনি মুরীদের অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ নৈকট্য মুবারক লাভ করানোর এক বিশেষ উসীলা বা মাধ্যম।

এ জন্যেই খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে নির্দেশ মুবারক করেন-

يَا أَيُّـهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّـقُوا اللهَ وَابْـتَـغُوْا اِلَيْهِ الْوَسِيْـلَةَ

অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করো এবং খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য মুবারক লাভ করার জন্য ওসীলা তালাশ (গ্রহণ) করো।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৫)

উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় “তাফসীরে রূহুল বয়ান” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে-

اَلْوُصُوْلُ لَا يَـحْصُلُ اِلَّا بِالْوَسِيْـلَةِ وَهِىَ الْعُلَمَاءُ الْـحَقِيْـقَةُ وَمشَائِخُ الطَّرِيْـقَةِ

অর্থ : “ওসীলা ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য মুবারক লাভ করা যায়না। আর উক্ত ওসীলা হচ্ছেন হাক্বীক্বী আলিম বা তরীক্বতপন্থী কামিল মুর্শিদ উনারা।”

মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজেই অন্যের অনুগত হতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَاتَّبِعْ سَبِيْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَىَّ

অর্থ : “যিনি আমার দিকে রুজু হয়েছেন, উনার পথকে অনুসরণ করো।” অর্থাৎ উনার অনুগত হও। (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা লুক্বমান শরীফ : সম্মানিত পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫)

কাজেই যে বা যারা বলবে যে মহান আল্লাহ পাক ছাড়া কারো অনুগত হওয়া আমার বা আমাদের পছন্দ নয়। সে বা তাদের খালিছ তওবা করে একথা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় সে বা তারা কাট্টা কাফির হবে।

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বর্ণনা ও আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয়েছে যে, হেদায়েত প্রাপ্তি ও খালেছ ঈমানদার হওয়ার জন্য প্রত্যেকের জন্য একজন কামিল শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত হওয়া ফরয অর্থাৎ ফরযে আইন। ছোহবত ইখতিয়ার করা ফরয, ছবক নেয়া ফরয ও জিকির আজকার করা ফরয। পীর সাহেব উনার সমস্ত আদেশ নিষেধ পালন করা ফরয। এবং সাথে সাথে খিদমত করাও ফরয। এর বিপরীত আক্বীদা পোষণ করা ও আমল করা কাট্টা কুফরী।

মুহম্মদ জামিল হুসাইন

ঘোড়াশাল, নূরানীবাদ

সুওয়াল: আমাদের মসজিদের ইমাম আগে ফজর ও আছরের ফরজ নামাযের পর মুছল্লীদের দিকে ঘুরে মুনাজাত করতেন আর যোহর, মাগরিব ও ইশা’র নামাযের পর না ঘুরে মুনাজাত করতেন। কিন্তু এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর ঘুরে বসেন। বিশেষ করে যোহর, মাগরিব ও ইশা’র ফরয নামাযের পর মুনাজাত শেষ করে অধিকাংশ মুছল্লিদেরকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে বিভিন্ন মাসনূন দোয়া পাঠ করেন। এরপর দু রাকায়াত সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামায আদায় করেন। এ বিষয়ে দলীল তলব করলে বুখারী শরীফ থেকে একটি হাদীছ শরীফ পেশ করে । এখন আমার জানার বিষয় হলো- পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর কি ঘুরে বসা সুন্নত? ও যেসব ফরয নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামায রয়েছে ঐ ফরয নামাযের মুনাজাতের পর কি মাসনূন দোয়া পাঠ বা দেরি করা যাবে? শরীয়তের দলীল সহকারে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: শরীয়তের হুকুম বা ফতওয়া হলো, যেসব নামাযে ফরযের পর সুন্নতে মুয়াক্কদাহ নামায রয়েছে যেমন- যুহর, জুমুয়াহ, মাগরিব, ইশা সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব ফরযের পর মুক্তাদীর দিকে ফিরে বা ঘুরে বসে মুনাজাত করবেন না। বরং ক্বিবলামুখী হয়েই মুনাজাত করবেন। মুনাজাতের পর সাথে সাথে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ আদায় করতে হবে। মুনাজাতের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামায না পড়ে মাসনূন দোয়া পাঠ করার জন্য দেরী বা বিলম্ব করা ঠিক হবে না। তা সুন্নত মুবারকের খিলাফ।

আর যেসব নামাযে ফরযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামায নেই যেমন- ফজর ও আছর সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব ফরয নামায শেষে মুক্তাদীর দিকে ঘুরে বসে মুনাজাত করবেন।

কেননা স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেসব ফরয নামাযের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামায নেই সেসব ফরয নামাযে সালাম ফিরানোর পর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন অতঃপর দুআ মুবারক করতেন। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتِ الْأَسْوَدِ الْعَامِرِيِّ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ: صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْفَجْرَ فَـلَمَّا سَلَّمَ اِنْحَرَفَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا

অর্থ: হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার পিতা হতে বর্ণনা করেন, উনার পিতা বলেন, আমি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে ফজর নামায পড়লাম। যখন তিনি নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন তখন তিনি ঘুরে বসলেন এবং উভয় হাত মুবারক উঠিয়ে দুআ (মুনাজাত) মুবারক করলেন। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ)

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِيِّ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ أَنَّهٗ قَالَ صَلَّى لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الصُّبْحِ بِالْحُدَيْبِيَةِ فَـلَمَّا انْصَرَفَ أَقْـبَلَ عَلَى النَّاسِ

অর্থ: হযরত যায়িদ ইবনে খালিদ জুহানী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে নিয়ে হুদায়বিয়াতে ফজরের নামায আদায় করলেন। যখন নামায শেষ করলেন তখন মুছল্লীগণের দিকে ফিরে বসলেন। (বুখারী শরীফ)

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتِ السُّدِّىِّ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ قَالَ سَأَلْتُ أَنَسًا رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ كَيْفَ أَنْصَرِفُ إِذَا صَلَّيْتُ عَنْ يَّمِيْنِىْ أَوْ عَنْ يَّسَارِىْ قَالَ أَمَّا أَنَا فَأَكْثَـرُ مَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَـنْصَرِفُ عَنْ يَّمِيْنِهٖ.

অর্থ: হযরত সুদ্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, নামায শেষ করার পর কিভাবে মুখ ফিরাবো, আমার ডান দিকে, না বাম দিকে? তিনি বললেন, মূলতঃ আমি অধিকাংশ সময় হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে উনার ডান দিকে ফিরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম শরীফ ও নাসায়ী শরীফ)

উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ সমূহ থেকে প্রতিভাত যে, যেসব ফরয নামাযের পর সুন্নত নামায নেই সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব সালাম ফিরানোর পর মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে বসবেন। তবে প্রথম কাতারে যদি মাসবূক মুক্তাদী থাকে তাহলে ইমাম ছাহেব ডান দিকে ফিরে বসবেন। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ফতওয়া দেয়া হয়েছে ডান দিকে ফিরাটাই খাছ সুন্নত মুবারকের অন্তর্ভুক্ত। আর ইমাম ছাহেব একজন মুক্তাদী নিয়ে নামায পড়লে সেক্ষেত্রে ইমাম ছাহেবকে পিছনে ফিরতে হবে না। বরং একটু ডান দিকে ফিরে বসবেন অতঃপর দুআ বা মুনাজাত করবেন। এটাই হচ্ছে সম্মানিত শরীয়ত উনার মাসয়ালা। এ মাসয়ালা মুতাবিক প্রত্যেক ইমাম ও মুছল্লীদের আমল করা অপরিহার্য কর্তব্য।

উল্লেখ্য, সুওয়ালকারীর মসজিদের ইমাম বুখারী শরীফ কিতাব থেকে যে পবিত্র হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছে তাতে কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর মুছল্লীদের দিকে ফিরে ইমাম ছাহেবের দুআ করার বিষয়টি বর্ণিত নেই।

কাজেই বুখারী শরীফ থেকে দলীল দিলেই সেটা আমল করতে হবে, তা নয়। কারণ বুখারী শরীফ কিতাবে অনেক হাদীছ মওজু বা জাল রয়েছে। যা মোটেও অনুসরণযোগ্য ও আমলযোগ্য নয়। আমলের ক্ষেত্রে ফিক্বাহের কিতাব অনুসরণীয়। অর্থাৎ মাজহাব অনুসরণ করতে হবে। (বাকী অংশ রঙিন পৃষ্ঠার পর)

 দলীলসমূহ: বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, নাসায়ী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, ফতহুল বারী, তাইসিরুল ক্বারী, মাআরিফে মাদানিয়াহ, তাহতাবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ফতহুল মুলহিম, শামী, কবীরী, দুররুল মুখতার, শরহে মুনিয়া, তাতারখানিয়া, খুলাছা, নূরুদ্দিরায়া, শরহে হিদায়া ইত্যাদি।

ডাঃ মুহম্মদ লুৎফর রহমান

মুন্সীগঞ্জ।

সুওয়াল: পাঠ্যবইয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষার নাম দিয়ে ছোট বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে ‘এসো লজ্জা ভাঙ্গি’ এ বিষয়ে শরীয়ত সম্মত জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: পাঠ্যবইয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে বয়ঃসন্ধির শিক্ষার নাম দিয়ে শেখানো হচ্ছে বয়ঃসন্ধী কালে নারী-পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কি নির্গত হয়, কিসের আকার পরিবর্তন হয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ ইত্যাদি। প্রকাশ্যে ছাত্র-ছাত্র একসাথে এসব শিক্ষা প্রদান মোটেও শরীয়ত সম্মত নয়। সম্পূর্ণ হারাম।

উল্লেখ্য শরীয়তে পর্দা করা ফরয। তাই ছাত্র ও ছাত্রীদের একসাথে পাঠ দানের প্রশ্নই আসেনা। কারণ বেপর্দা হওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। আর যে বা যারা হারামকে যায়েজ মনে করে বা বলে সে বা তারা কাট্টা  কাফের হবে। তাহলে ছাত্র ও ছাত্রীরা কি করে একসাথে পড়াশুনা করতে পারে? এছাড়া পবিত্র হাদীছ শরীফে আছে, লজ্জা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই তার ঈমান নেই।

পবিত্র হাদীছ শরীফ অনুযায়ী শ্রেণীতে এসব পড়িয়ে মূলত বাচ্চাদের ঈমানহারা করা হচ্ছে।

কেউ কেউ বলে, এসব শিক্ষার অভাবে নাকি বাচ্চারা সমস্যায় পড়ে। নাঊযুবিল্লাহ! ধরা যাক, এসব শিক্ষা না নিলে বাচ্চাদের কিছু ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এসব শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে কোন ছাত্র বা ছাত্রী যদি চরিত্র নষ্ট করে ফেলে তখন তার কতটুকু ক্ষতি হবে? দুই ক্ষতির তুলনা করলে কোনটা বেশি ভয়াবহ?

আসলে ইহুদীদের চলমান সংস্কৃতি ধ্বংসকারী (কাউন্টার কালচার) ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অনেক দেশেই বাচ্চাদের পাঠ্যবইয়ে যৌন শিক্ষা প্রবেশ করানো হয়েছে। যার প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশের অভিভাবকরা ব্যাপক আন্দোলন-বিক্ষোভ করছে। কিন্তু এ দেশের পাঠ্যপুস্তকে এই শিক্ষা যৌন শিক্ষা নামে আসেনি, এসেছে স্বাস্থ্য শিক্ষার নামে।

বস্তুত মানুষ মাত্রই বড় হবে, বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছাবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আজকে যারা মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানীরা, খালা-মামারাও এক সময় এই বয়সে ছিলেন। উনারা সময়মত প্রয়োজনীয় সমাধানও পেয়েছেন। কিন্তু উনারা ঘোষণা দিয়ে বয়ঃসন্ধির শিক্ষা নেননি বলে উনাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে এমনটা নয়। বরং আজকের যুগে অভিভাবকরা আরো ভয়ের মধ্যে থাকেন, না জানি উনাদের সন্তান কি ভুল করে বসে। তার মধ্যে এই শিক্ষা অনেকটা নতুন প্রজন্মকে আরো উস্কে দেয়ার নামান্তর। বিশেষ করে, বয়ঃসন্ধীকালীন শিক্ষাটা নারী-পুরুষের জন্য পৃথক। সে জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের একজন অন্যজনেরটা জানার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু পাঠ্যবই ও শ্রেণীতে একসাথে ছেলে-মেয়েদের তা শেখানো হচ্ছে। যা চরিত্র নষ্টের কারণ। তাই তা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েজ।

স্বাস্থ্য শিক্ষা মূলত দুই ধরনের হয়।

এক. যা জনসম্মুখে বলা ও প্রয়োগ করা যায়।

দুই. যা শেখা ও প্রয়োগের জন্য গোপনীয়তা দরকার।

বয়ঃসন্ধীকালীন শিক্ষার নাম দিয়ে যা শেখানো হচ্ছে, তা এক ধরণের গোপন শিক্ষা, যা শেখা ও প্রয়োগের জন্য গোপনীয়তা দরকার। এই শিক্ষার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা জনসম্মুখে, ঘোষণা দিয়ে নয় বরং গোপনীয়তা রক্ষা করে শেখানো উচিত।

এখানে বিষয়টি বুঝতে হবে, একটা শিশুর যখন দাঁত জন্মায়, তখন সে কামড় বসিয়ে তার ব্যবহার করতে চায়। একটি শিশু যখন হাঁটার শক্তি পায়, তখন বার বার হেঁটে তার ব্যবহার করতে চায়। ঠিক তেমনি একটি শিশু বয়ঃসন্ধিকালে যে নতুন ক্ষমতা পায়, তারও যথেচ্ছ ব্যবহার সে করতে চাইতে পারে। এজন্য বয়ঃসন্ধিকাল একটি স্পর্শকাতর সময়। এর নিয়ন্ত্রণও সেভাবেই করা উচিত। বর্তমান পাঠ্যবইয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতে শিশুটি ভুল বুঝে বেপরোয়াও হয়ে যেতে পারে, যা খুবই ভয়ঙ্কর বিষয়।

আসলে এসব শিক্ষা শালীনতার সাথে অভিভাবকরা যেন বাসাতেই দিতে পারেন, সেজন্য অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করা দরকার, প্রয়োজনে উনাদেরকে দিক নির্দেশনা সমৃদ্ধ বই দেয়া যেতে পারে। এছাড়া প্রতি শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করার জন্য একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক থাকেন, যিনি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। ঐ শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের বন্ধুর মত সম্পর্ক থাকে, যেন তারা মন খুলে তাদের সমস্যাগুলো বলতে পারে। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম পর্যন্ত শ্রেণীতে যদি পরিচালক শিক্ষকরা বিষয়টি একটু খেয়াল রাখেন, তবে কোন শিক্ষার্থী যদি বাসায় পর্যাপ্ত শিক্ষা নাও পায়, তবে পরিচালক শিক্ষক সেই শূণ্যতা পূরণ করে দিতে পারেন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টির জন্য এত ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজন নেই, বরং সুন্দর ও স্বাভাবিক নিয়মে শালীনতার সাথে শিক্ষাটি প্রদান করা সম্ভব।

আসলে বিশ্বজুড়ে বাচ্চাদের বইয়ে যারা এসব বিষয় প্রবেশ করিয়েছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়, বরং তাদের লজ্জাশীলতা ধ্বংস করে বেপরোয়া করা। এটা মূলত ইহুদীদের বৈশ্বিক কার্যক্রম, যার মাধ্যমে কোন একটি দেশের সামাজিক নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হয়।

মূলতঃ বিধর্মী ষড়যন্ত্রে এ দেশের পাঠ্যবইয়ে এ বিষয়গুলো প্রবেশ করানো হয়েছে। তাই অভিভাবকদের উচিত এসব ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং পাঠ্যবই থেকে তা বাদ দেয়ার জন্য জোর দাবী তোলা।

মনে রাখতে হবে, একজন অভিভাবক তার সন্তানকে কি পড়াবেন আর কি পড়াবেন না- এ বিষয়ে কথা বলার পূর্ণ অধিকার আছে এবং রয়েছে। সুতরাং অভিভাবক মহলকেই এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে মুসলমান দেশে এই সমস্ত বিষয় প্রকাশ্যে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করে ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয়া।

অতএব এই প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়েজ। যা থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে বেঁচে থাকা ফরয।

কাজেই প্রত্যেক মুসলমান অভিভাবকদের জন্য ফরয হলো যে, তাদের সন্তানরা যেন দ্বীন ইসলাম বিরোধী শিক্ষা গ্রহন না করে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।

আহমদ মনোয়ার

নূরানীবাদ

সুওয়াল : কোন মাস ও দিনকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা এবং কোন রোগ-ব্যাধিকে ছেঁায়াচে বা সংক্রামক মনে করার ব্যাপারে সম্মানিত শরীয়তে কোন বিধি-নিষেধ আছে কি না? জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : কোন মাস ও দিনকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা কুফরী এবং একইভাবে কোন রোগ-ব্যাধিকে সংক্রামক বা ছেঁায়াচে মনে করাটাও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

বর্ণিত রয়েছে, আইয়্যামে জাহিলিয়াতে ছফর মাসকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা হতো। মহান আল্লাহ পাক উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব, মাহবূব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদের সে ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেন।

যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‏ لَا عَدْوٰى وَلَا هَامَةَ وَلَا نَوْءَ وَلَا صَفَرَ

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব, মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। পেঁচার মধ্যে কুলক্ষণের কিছুই নেই। তারকার (উদয় বা অস্ত যাওয়ার) কারণে বৃষ্টি হওয়াটাও ভিত্তিহীন এবং ছফর মাসে অশুভ বলতে কিছু নেই।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ-৩৯১, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৭১)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ عَنْ رَّسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اَلطِّيَرَةُ شِرْكٌ قَالَهٗ ثَلَاثًا

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব, মাহবূব নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,“যে কোন বিষয়কেই অশুভ ও  কুলক্ষণে মনে করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তিনি এ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করেছেন।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী শরীফ, মাওয়ারিদ, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল-১/৪৩৮, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৭৪, মিশকাত শরীফ-৩৯২, শরহুত্  ত্বীবী-৮/৩২)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ عَدْوٰى وَلَا صَفَرَ وَلاَ هَامَةَ ‏فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَا بَالُ الْإِبِلِ تَكُوْنُ فِي الرَّمْلِ كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ فَيُخَالِطُهَا الْبَعِيْرُ الْأَجْرَبُ فَيُجْرِبُهَا‏ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‏ فَمَنْ أَعْدَى الْأَوَّلَ‏‏.‏

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব, মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “কোন রোগই সংক্রামক নয়। পেঁচার মধ্যে কুলক্ষণের কিছুই নেই এবং ছফর মাসের মধ্যেও অশুভ কিছু নেই। তখন এক ব্যক্তি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তাহলে উটের এ অবস্থা হলো কেন, যে উটগুলো ছিল জংলী হরিণের মত তরু-তাজা, যেগুলো ময়দানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতো। এমতাবস্থায় কোথা হতে এক চর্মরোগাক্রান্ত উট এসে সে উটের পালে মিলিত হলো এবং উটগুলোকে চর্মরোগী বানিয়ে দিলো। ফলে এ উটগুলোও খুজলীযুক্ত হয়ে গেলো। তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, তাহলে প্রথম উটটির চর্মরোগ কোথা থেকে আসলো? অর্থাৎ প্রথম উটটি যেভাবে খুজলীযুক্ত হয়েছিল ঠিক পরবর্তী উটগুলোও সেভাবে খুজলীযুক্ত হয়েছে।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ/৩৯১, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৬৫)

স্মরণীয় যে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যসূচিতে ইসলামী আক্বায়িদ সংক্রান্ত ইলিম না থাকার কারণে কোন কোন চিকিৎসক কিছু কিছু রোগ সম্পর্কে যেমন- চর্মরোগ, খুজলী-পাঁচড়া, কুষ্ঠ, কলেরা-বসন্ত ইত্যাদিকে সংক্রামক বা ছেঁায়াচে বলে অভিমত ব্যক্ত করে থাকে। যা সম্মানিত ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাজেই, এরূপ ভ্রান্ত ও কুফরী আক্বীদা হতে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তভুর্ক্ত।

তবে ভাল লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা করার অবকাশ আছে। অর্থাৎ তা মুস্তাহাব-সুন্নত মুবারক। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَا طِيَرَةَ وَخَيْرُهَا الْفَأْلُ ‏‏قَالُوْا وَمَا الْفَأْلُ قَالَ ‏الْكَلِمَةُ الصَّالِحَةُ يَسْمَعُهَا أَحَدُكُمْ

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি শুনেছি যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “কোন বিষয়কে অশুভ কুলক্ষণে মনে করোনা, তবে শুভ লক্ষণ আছে। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শুভ লক্ষণ কি? তখন তিনি বললেন, উত্তম কথা, যা তোমাদের মধ্য হতে কেউ শুনতে পায়।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহুত্ ত্বীবী-৮/৩১৩, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৭২)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে সমাজে আরো যেসব কুফরীমূলক ভ্রান্ত আক্বীদা ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে তা হচ্ছে: (১) রাস্তা চলার সময় কোন প্রাণী যদি ডান দিক থেকে রাস্তা অতিক্রম করে বাম দিকে যায় তাহলে গমন শুভ, কল্যাণকর হবে। আর যদি বিপরীত দিকে যায় তাহলে কুলক্ষণে বা অকল্যাণ হবে, এরূপ বিশ্বাস করা। (২) শান্তির প্রতীক বা শান্তি লাভের আশায় পাখি উড়িয়ে দেয়া।

(৩) ঘুম থেকে উঠে পেঁচা দেখা কিংবা রাতে পেঁচার ডাক শুনলে কুলক্ষণের পূর্বাভাস মনে করা।

(৪) অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি কোন বন্ধ্যা ব্যক্তিকে দেখতে পায়, কিংবা খালি কলস দেখতে পায় তাহলে সারাদিন অকল্যাণভাবে অতিবাহিত হবে বা কোন কল্যাণ অর্জিত হবেনা বলে ধারণা করা।

(৫) সাবত বা শনিবার এবং ছুলাছা বা মঙ্গলবার ইন্তিকাল করাকে কুলক্ষণ এবং জাহান্নামী হওয়ার আলামত বলে মনে করে। যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা বা কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা হযরত নবী আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিদ্দীক্বে আকবর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি ছুলাছা বা মঙ্গলবার দিন পবিত্র বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেন। আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ খলীফা, খলীফাতুল মুসলিমীন, যথাক্রমে সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনারা সাবত বা শনিবার দিন পবিত্র বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেন।

(৬) পরীক্ষার পূর্বক্ষণে ডিম বা কলা খাওয়াকে পরীক্ষা পাশের প্রতিবন্ধক মনে করা। (৭) সময়কে গালি দেয়া, জোরে বাতাস প্রবাহিত হতে দেখলে বাতাসকে গালি দেয়া, আকাশে দীর্ঘ সময় মেঘ থাকতে দেখলে মেঘকে গালি দেয়া ইত্যাদি।

অতএব, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে নিজেদের ঈমানকে হিফাযত করতে হলে যাবতীয় কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকাটা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।

আহমাদ মারগূবা জান্নাত

নূরানীবাদ

সুওয়াল: হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফাযায়িল-ফযীলত সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: মহান আল্লাহ পাক উনার ওলীগণ উনাদেরকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করার কথা খোদ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যেই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

يٰاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَاُولِى الْاَمْرِ مِنْكُمْ

অর্থ : ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক, উনার রসূল ও উলিল আমরগণ উনাদেরকে অনুসরণ কর।’ (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৯)

আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

اَحِبُّوْا اَوْلِيَاءَ اللهِ فَاِنَّهُمْ هُمُ الْـمَقْبُوْلُوْنَ وَلَا تَبْغَضُوْهُمْ فَاِنَّهُمْ هُمُ الْـمَنْصُوْرُوْنَ

অর্থ: ‘তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার ওলীগণ উনাদেরকে মুহব্বত কর। কারণ, উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট মকবূল। আর উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না। কেননা, উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত।’

মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরই নির্দেশ মুবারক হচ্ছে, উলিল-আমর তথা মহান আল্লাহ পাক উনার ওলীগণ উনাদেরকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করা। আর আফদ্বালুল আউলিয়া, কাইয়্যূমে আউওয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হলেন একজন খাছ উলিল আমর বা মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী তথা সত্যিকার নায়িবে রসূল।

ক্বইয়্যূমে আউওয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এমনই একজন উলিল আমর বা নায়িবে রসূল, উনার সম্পর্কে স্বয়ং আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

يُبْعَثُ رَجُلٌ عَلٰى اَحَدَ عَشَرَ مِأَةِ سَنَةٍ وَهُوَ نُوْرٌ عَظِيْمٌ اِسْمُهٗ اِسْمِىْ بَيْنَ السُّلْطٰنَيْنِ الْجَابِرَيْنِ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ بِشَفَاعَتِهٖ رِجَالًا اُلُوْفًا.

অর্থ: “হিজরী একাদশ শতাব্দীর আরম্ভকালে মহান আল্লাহ পাক তিনি এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি একটি বৃহৎ নূর। উনার নাম মুবারক হবে আমার নাম মুবারক উনার অনুরূপ। দুই অত্যাচারী বাদশাহর রাজত্বকালের মাঝে তিনি আবিভূর্ত হবেন এবং উনার সুপারিশে অগনিত মানুষ বেহেশতে প্রবেশ করবে।” সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

يَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ رَجُلٌ يُقَالُ لَهٗ صِلَةٌ يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ بِشَفَاعِتِهٖ كَذَا وَكَذَا مِنَ النَّاسِ

অর্থ: “আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আগমন করবেন যাঁকে ‘ছিলাহ’ উপাধি দেয়া হবে। উনার সুপারিশের কারণে অগণিত লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।” সুবহানাল্লাহ!

সুলত্বানুল আরিফীন হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার ‘জামউল জাওয়াম’ ও ‘জামিউদ্ দুরার’ কিতাবে উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দু’খানা উল্লেখ করেছেন।

‘সম্রাট আকবর’ সৃষ্ট ফিৎনার চরম সময়ে ৯৭১ হিজরীর ১৪ই শাওওয়াল (ইংরেজি ১৫৬৩ সাল) ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিলাদত শরীফ গ্রহণ করেন পাঞ্জাব প্রদেশের পাতিয়ালার সিরহিন্দ শরীফ-এ। মাত্র ছয় বছর বয়স মুবারকে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ হিফয করেছিলেন। অতঃপর কানপুরস্থ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে জগৎ বরেণ্য আলিমগণের নিকট তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র তাফসীর শরীফ, ফিক্বাহ শরীফ, সাহিত্য, কাব্য, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞানসহ ইসলামী ইলমের সকল শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কামালতের পরিপূর্ণ ধাপে উত্তরণের জন্য তিনি ওলীকুল শিরোমনি হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে বাইয়াত হন।

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে মুরীদ হওয়ার পূর্বেই উনার বুযূর্গ পিতা হযরত শায়েখ আব্দুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে চৌদ্দটি তরীক্বার কামালত হাছিল করেন। এ সমুদয় তরীকা বিশ্লেষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে উনার ‘মুজাদ্দিদসুলভ’ কামালতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আরো যুক্ত হয় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে পাওয়া খাছ কামালতসমূহ। অতঃপর মহান আল্লাহ পাক উনার মনোনীত দ্বিতীয় সহস্র হিজরীর ‘মুজাদ্দিদ’ হিসেবে উনার মধ্যে সমাবেশ ঘটে ইমামত ও কাইয়্যুমিয়াতের। মহান আল্লাহ পাক উনার প্রদত্ত নিয়ামত ও যোগ্যতাবলে তিনি নক্্শবন্দিয়া তরীক্বার সংস্কার সাধন করেন এবং নুবুওওয়াতে কামালাতের সাথে এ তরীক্বার সেতুবন্ধন রচনা করেন। এভাবে পৃথিবীতে সকল কামালাতের সংযোগ বিশিষ্ট ‘মুজাদ্দিদিয়া তরীক্বা’ প্রকাশ ঘটে। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পরে এই তরীক্বা অথবা অন্য কোন সিলসিলায় এমন প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির কথা বাহ্যিকভাবে জানা যায়নি।

আকবর নিদারুণ মর্মপীড়া ও শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। অবশেষে ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজত্বের অবসানে ১৬০৬ সালে আকবরের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে তার আদর্শ সঞ্চারিত করে যায় তার পুত্র জাহাঙ্গীরের মন ও মননে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তার আটত্রিশ বছরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। একপর্যায়ে নূরজাহান, আসিফ খান এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গ ও আমলাদের সুপারিশে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জাহাঙ্গীর কারাবন্দি করেন। এ কারাবাসকে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি- নির্জনতায় উনার মর্যাদা ও মর্তবা উত্তরণের অনুকূল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুদীর্ঘ দু’বছর কারাবাসকালে উনি উনার নিয়ামতপূর্ণ ছোহবত দান করে অনেক কারাবন্দিকে হিদায়েতের পথে এনেছেন। এরই মাঝে উনার অসংখ্য মুরীদ ও খলীফার মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। স¤্রাট জাহাঙ্গীর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উনাকে গোয়ালিয়ার দুর্গ থেকে মুক্তি দিয়ে রাজ দরবারের অন্তঃপুরে নজরবন্দি করে রাখেন। অবশেষে বিজয় সূচিত হয় তখন, যখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক নির্দেশ স্বপ্নযোগে পেয়ে স¤্রাট জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে উনার কাছে মুরীদ হন।

সম্রাট আকবরের সময়ে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাস্তবায়িত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মানসিক দিক দিয়ে পযুর্দস্ত জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে কারাবাস থেকে মুক্তি দিয়ে উনার সাক্ষাৎলাভের অনুমতি প্রার্থনা করেন। সাক্ষাৎ দানের পূর্বে তিনি যেসব শর্ত আরোপ করেছিলেন তা হলো- (১) রাজ দরবারে তা’যীমী সিজদা প্রথা রহিতকরণ (২) সকল মসজিদের পুনঃনির্মাণ (৩) জিযিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন (৪) ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য কাজী ও মুফতী নিয়োগ (৫) সকল বিদয়াত কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ; (৬) গরু যবেহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা রহিতকরণ; (৭) সংস্কার আন্দোলনে সকল কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্তিদান।

সম্রাট জাহাঙ্গীর সকল শর্তই মেনে নিয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি উনার মুরীদ হন এবং উনার উপদেশ মতো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। উনার উপদেশেই জাহাঙ্গীর শাসননীতিতে ইসলামী আইন সংযোজন করেন। জাহাঙ্গীর শেষ জীবনে প্রায়ই বলতেন, “আখিরাতে নাজাত পেতে পারি, এমন কোন কাজ (আমল) আমি করিনি। তবে আমার কাছে একটি সনদ আছে, আখিরাতে আমি তা মহান আল্লাহ পাক উনার সমীপে পেশ করবো। সে সনদ এই যে, একদিন হযরত শায়েখ আহমদ ফারুক্বী সিরহিন্দী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আমাকে বলেছেন- যদি মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দান করেন তবে আপনাকে ছেড়ে যাবো না।” সুবহানাল্লাহ!

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ জীবনে সুন্নতের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল করেন। মানুষের মাঝে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত অনুসরণের স্পৃহা জাগিয়ে তুলে তিনি অবলুপ্ত সকল সুন্নত যিন্দা করেন। এজন্য উনাকে বলা হয় ‘মুহইস সুন্নাহ’।

সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসারী এবং মহান আল্লাহ পাক উনার যমীনে সুন্নত যিন্দাকারী হাজার বছরের মুজাদ্দিদ- হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি উনার বড় সাধ, উনার কর্মময় জীবনাবসানের সর্বশেষ কাজটিও যেনো সুন্নতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। তিনি আপনজন, খলীফা ও মুরীদগণকে ডেকে বললেন, “ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে পৃথিবী থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক দীদারে প্রত্যাবর্তন করেন।” অবশেষে সময় ঘনিয়ে এলো। তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে বিছাল শরীফ দান করে আমল ও ক্ষমতা বহিভূর্ত সুন্নত অনুসরণের উনার এই অন্তিম বাসনাকে মহান আল্লাহ পাক তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! হিজরী ১০৩৪ (ইংরেজি ১৬২৪ সাল) ২৮শে ছফর শরীফ তিনি বিছাল শরীফ গ্রহণ করেন।

অতএব, প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- আফদ্বালুল আউলিয়া, কাইয়্যূমে আউওয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সম্পর্কে জানা, উনাকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের খাছ রেযামন্দি হাছিল করা।

 সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ