সম্পাদকীয়

সংখ্যা: ১৭৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

সব প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক-এর জন্য। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অফুরন্ত দরূদ ও সালাম।

একটা বিষয় বড় সুক্ষ্ম অনুভবের হলেও তা খুব স্পষ্ট। এযুগে যা অতি ব্যাপক।  গভীর বিস্তৃত এবং চরম সত্য।  এ যুগের মুসলমানের জন্য সবচেয়ে ক্ষতি কারক রোগ কোনটি? এর প্রনিধানযোগ্য এবং সহজ উত্তর হলো- আলোচিত হওয়া, পরিচিতি পাওয়া। প্রাধান্য লাভ করা তথা মিডিয়ায় স্থান পাওয়া। গ্ল্যামার গার্ল অথবা বয় খ্যাত হওয়া। সেলিব্রেটির অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তারকাখ্যতি লাভ করা।

হার্টফ্রুব নায়ক-নায়িকা হওয়া। হলিউড, বলিউড ঢালিউড ইত্যাদির সেরা নায়ক-নায়িকা হওয়া। কিন্তু এ মনোভাবের সংক্রামক ব্যধি এখন এতই প্রকট যে এ মানসিকতা সম্পন্নদের সংখ্যাধিক্যে তথাকথিত শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে এখন প্রকাশ্য অশ্লীলতার শেষ মাত্রায় পৌছেও কথিত তারকাখ্যতি পেতে তারা একান্ত আগ্রহী এবং নিবেদিত প্রতিযোগী।

 তাই এখন ‘বিশ্ব সুন্দরী’ শুধুই নয় বিশ্বখ্যাত যৌন আবেদনময়ী মহিলা হওয়ার জন্যও অসম্ভব রকমের হুড়োহুড়ি।

মিডিয়ায় স্থান পাওয়ার প্রবণতা মানুষকে আজ পশ্বাধম করেছে। অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্কের অনুষ্ঠানে সিক্সটি মিনিটস প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিরল দৃষ্টান্ত দেখানোর প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তথাকথিত মিডিয়ায় স্থান পাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় খবর হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার জন ডিভেস তার নিজ কন্যা জেনি ডিভেস-এর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আর এতে নির্বিকার কন্যা ও পিতা উভয়ই। এবং এভাবে মিডিয়ায় স্থান পেয়ে, অস্ট্রিলিয়ান চ্যানেল লাইন নেটওয়ার্কে প্রদর্শিত হতে পেরে তারা দু’জনেই খুব খুশি। (নাঊযুবিল্লাহ)

এদিকে বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদিতে ক্রীড়া নৈপুন্য দেখানোর পাশাপাশি ইদানিং উদ্ভব হয়েছে কোটি কোটি মানুষের সামনে নিজেদের দেহ বল্লরী বিবস্ত্রভাবে প্রদর্শনকারীদের। এরা খ্যাতি পেতে চায় চিয়ার গার্ল হিসেবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ১৮ই এপ্রিল  মুম্বাইয়ে টোয়েন্টিলীগের ২০ আইপি এলের ম্যাচ চলাকালে কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ-আফ্রিকা থেকে বেশ কিছু চিয়ার লিডার্স আনা হয়। ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এই চিয়ার লিডার বা চিয়ার গার্লদের উদ্ভব। ভারতের মাঠে এবারই প্রথম তাদের আনা হয়। তবে ভারতে মন্তব্য উঠেছে ভারতে তথা উপমহাদেশের সংস্কৃতির সাথে তা বেমানান। ভারতের সংস্কৃতি ওদের বেলেল্লাপনা সমর্থন করেনা। অতপর ভারতে মুম্বাইরাষ্ট্রের সরকারও বলেছে মুম্বাই ইন্ডিয়ান বনাম ডেকানি বাজার্সের খেলায় স্বল্পবসনাদের দিয়ে নাচগান সরকার বরদাস্ত করবে না।

তবে বাংলাদেশে বেশ অবাধেই চিয়ার গার্লদের উদ্ভব হচ্ছে। প্রথম প্রথম বলে তাদের বসন ততটা স্বল্প না হলেও আস্তে আস্তে যে তা ক্রমশই সংক্ষিপ্তে পরিণত হবে এবং এখানেও পুরোদস্তর পাশ্চাত্য বিবস্ত্র সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে- তার প্রতিক্রিয়া কোন মহলে নেই। ভারতে যখন চিয়ার লিডারদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে তখন এদেশে সংবাদ শিরোনাম হয়, “পাইয়োনিয়ারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তরুনীরা নেচে গেয়ে খুদে ফুটবলারদের মাতিয়ে রাখে।”

উল্লেখ্য, বাংলাাদেশের  খেলাধুলার সংস্কৃতিতে জাতীয় প্রতিযোগীতার বাইরে কথিত চিয়ার গার্ল প্রক্রিয়া যে ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়েও পৌছেছে খবরটি তারই প্রমাণ বহন করে।

এদিকে বাংলাদেশে এখন তৈরী হচ্ছে হাজার হাজার সিনেমা, টেলিফল্ম, মুভি, ডকুমেন্টারী নাটক, ধারাবাহিক নাটক, মেগাসিরিয়াল নাটক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। আর তাতে করে এখন আগের চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশী নায়ক-নায়িকার ভীর। এ ভীড়ে যারা চান্স না পান ক্লোজআপ ওয়ান, চ্যানেল আই, সেরাকণ্ঠ প্রতিযোগীতা, ফটোলাক্স সুন্দরী, দারুচিনি দ্বীপের নায়িকার খোঁজ, ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় লাখে লাখে তারা ঐসব প্রতিযোগীতার ভীরে গলদঘর্ম হন। উদ্দেশ্য ঐ একই- মিডিয়ার জাতে উঠা।

ইদানিং আবার উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা সরকারী প্রভাব খাটিয়ে তাদের বউদের গানের অ্যালবাম প্রকাশ করছেন। আর শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা, বউদের গানের সিডি প্রকাশের পর লাখ লাখ টাকা খরচ করে পোস্টার ছাপেন। এমনকি ওষুধ কোম্পানীর মত রিপ্রেজেনটেটিভও নিয়োগ করেন। যাদের কাজ হয় ঘুরে ঘুরে ভিডিও-সিডিওর দোকানগুলোতে পুশিং সেল করা। বলার অপেক্ষা রাখে না এসব কিছুর উদ্দেশ্যও ঐ একই- মিডিয়াখ্যাতি পাওয়া। তারকাখ্যাতি লাভকরা। সেলিব্রেটি হওয়া।

এই মিডিয়া প্রবণতা এখন এতই তুঙ্গে যে তা রীতিমত অমানবিক হয়ে উঠেছে। এজন্য দেখা গিয়েছে টিভি ক্যামেরা ম্যান থাকা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের ত্রাণ দেয়া চলে। ক্যামেরা ম্যান প্রস্থান মাত্রই ত্রান দেয়াও শেষ। মিডিয়া পাগল মন্ত্রীদের দেখা গেছে নির্ধারিত সময়ের আগে হাজির হয়ে শুধু মিডিয়ার মুখ দেখানোর জন্য বক্তৃতার ভান বা ফটোসেশন করে তারা চলে যেতেন।

সমাজের চুনোপুটি থেকে রুই-কাতলা সবাই আজ এই মিডিয়া জ্বরে ভুগছে।

আর এই জ্বরেরর চিকিৎসা যাদের করার কথা ছিল তারা নিজেরাই মুমূর্ষ হয়ে আছে। তারা নিজেরাই মিডিয়া বুভুক্ষু। টিভিতে চান্স পাওয়ার আশায় প্রোগ্রাম অফিসারের বাসার বাজার পর্যন্ত তারা করে দেয়। অনুনয় বিনুনয় পা ধরা পর্যন্ত পৌছায়। আর কোনমতে চান্স মিললে পরে তাদের নামে পোস্টার ছাপানো হয়, রেডিও-টিভির ভাষ্যকার।

বলাবহুল্য, নামধারী এসব মাওলানাদের মাঝেও চলছে মিডিয়ায় স্থান পাওয়ার চরম ও তীব্র প্রতিযোগিতা। এজন্য শুধু বিটিভিই নয় বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোতেও এখন এদের নির্লজ্জ পদচারণা, তীব্র প্রতিযোগিতা।

আজকের মানুষ যে মিডিয়া উন্মাদ হয়ে আছে তার পেছনে এই মিডিয়া মুখী মাওলানা নামধারীরাই মুখ্যতঃ দায়ী। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মিডিয়া প্রবণতার মূল কথা হলো রিয়া বা লোক দেখানো  মনোভাব। যাকে বলা হয় গোপন শিরক।

আর আল্লাহ পাক্ ইরশাদ করেন, “অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় রবের দর্শন লাভের আশা রাখে তার উচিৎ যে সে সৎ কাজ করে এবং আপন রবের ইবাদতে কাকেও শরীক না করে। অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন যে, “আল্লাহ পাক অন্য সব গুনাহ ক্ষমা করেন কিন্তু  শিরকের গুনাহ ক্ষমা করেন না।”

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,  আমার উম্মতের জন্য গোপন শিরক বিষয়ে আমি যেরূপ ভয় করি অন্য কোন বিষয়ে আমি তদ্রুপ ভয় করি না।” সমবেত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নিবেদন করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! গোপন শিরক কি? তিনি বললেন, ‘রিয়া’। (লোক দেখানো তথা লোকের কাছে বাহবা কুড়ানোর মনোভাব- যা আজকের মিডিয়ায় স্থান পাওয়া, তারকাখ্যাতি লাভ করা বা সেলিব্রেটি হওয়ার মানসিকতা) কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক বলবেন, “হে রিয়াকারগণ, যাদের উদ্দেশ্যে তোমরা ইবাদত করেছ তাদের নিকট গমন কর এবং তাদের নিকট হতেই তোমাদের প্রতিদান চেয়ে নেও।”

একবার রসূলে মাকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, জুব্বুল হুযূন হতে আল্লাহ পাক–এর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ‘জুব্বুল হুযূন’ কি? তিনি বললেন, রিয়াকার আলিমদের (শাস্তির) জন্য ইহা দোযখের একটি (উপত্যকা) গর্ত।

তিনি বলেন, আল্লাহ পাক বলেন, যে ব্যক্তি ইবাদতকালে অন্যকে আমার সহিত শরীক করে (অর্থাৎ অন্যকে দেখানোর জন্য ইবাদত করে (আমি তাহার ইবাদত গ্রহণ করি না; বরং) এরূপ ইবাদতের সমস্তই আমি ঐ শরীককে দিয়ে দেই; কেননা অংশীরূপ কলঙ্ক হতে আমি মুক্ত।

রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ইবাদতে রেণু পরিমাণ রিয়া বা লোক দেখানো বাহবা কুড়ানোর মনোভাব থাকে আল্লাহ পাক তা গ্রহণ করবেন না।

আর এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে ইরশাদ  হয়েছে, “ঐ মুছুল্লীর জন্য জাহান্নাম যে লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে।” অথচ নামাযকে বলা হয়েছে, বেহেশতের চাবি। তারপরেও সে নামাযই মুছল্লীকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে যদি নামাযীর মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব থাকে।

উল্লেখ্য, রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব সম্পর্কে কোরআন সুন্নাহর এরূপ সতর্ক বানী হাজার হাজার। কিন্তু তারপরেও নামধারী মাওলানারা সে বিষয়ে মানুষকে নছীহত করা তো দূরের কথা বরং নিজেরাই তা আমল করেনা।

মূলতঃ তারা এখন রিয়ার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ছবি তোলা, বেপর্দা হওয়া, লংমার্চ মৌলবাদ, হরতাল, ব্লাসফেমী, ইসলামের নামে নির্বাচন, গণতন্ত্র, ইত্যাদি কাজে তারা কাট্টা ও কঠিন রিয়াকার হওয়ার কারণেই মশগুল আছে।

আপাদমস্তক রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা মিডিয়া মুখী হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষ মিডিয়া প্রবণতার মাঝে- অনৈসলামী দৃষ্টিভঙ্গী দেখতে অনভ্যস্ত ও উদাসীন হয়ে আছে। ফলত তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে আজ বিধর্মীদের হতে লাঞ্ছিত ও নিপীড়ীত হচ্ছে।

তাই এসব মিডিয়া প্রবণ-রিয়াকার নামধারী মাওলানা, শাইখুল হাদীছ, মুফতি, মোফাচ্ছিরে কুরআন, ইত্যাদি ধর্মব্যবসায়ী উলামায়ে ছূ’দের পরিবর্তে চাই যামানার মুজাদ্দিদ তথা মুজাদ্দিদে আ’যমের ছোহবত। তাঁর রূহানী নেয়ামতেই সম্ভব মিডিয়ার প্রবণতা ও তার দুষ্ট প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করা। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তা নছীব করুন। আমীন।

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়